এক কথায় বলতে গেলে যিনি শ্রম দেন তিনিই
শ্রমিক, তবে আইনের ভাষায় হওয়া উচিৎ- যিনি মজুরী বা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে শ্রম দেন তিনিই
শ্রমিক। কিন্তু বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বিধিমালায় শ্রমিকের সংজ্ঞা বিষয়ে একটি বড় ধরণের
বৈপরীত্য রয়েছে যেটিকে বৈষম্যও বলা যেতে পারে। এই বৈষম্য বা বৈপরীত্য তুলে ধরতে হলে
আগে জানতে হবে বাংলাদেশ শ্রম আইন ও বিধিমালায় এ সম্বন্ধে কি বলা আছে। আসুন জেনে নেই।
বাংলাদেশ শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিকের
সংজ্ঞা – শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোন ব্যক্তি, তাহার চাকুরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা
উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোন প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার
(যে নামেই অভিহিত হউক না কেন) এর মাধ্যমে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ,
কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরি কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, কিন্তু
প্রধানত প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি
ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন না।
খেয়াল করুন প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা
ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন না (২০০৬ ও
২০১৩)।
এরপরে ২০১৫ সালে বিধিমালায় এই তদারকি
কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি এর সংজ্ঞা
দেয়া হয়েছে।
তদারকি কর্মকর্তা – অর্থ মালিক বা ব্যবস্থাপনা
কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত এমন কোন ব্যক্তি যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা
বা প্রতিষ্ঠানের কোন শাখার কোন কাজের বা সেবার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, কাজের পরিধি
নিয়ন্ত্রণ, বাস্তবায়ন কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ, কাজের মূল্যায়ন বা পর্যালোচনা, শ্রমিকদের
দিক নির্দেশনা প্রদান বা তদারকি করেন।
প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত
ব্যক্তি – মালিক বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক লিখিতভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তি
যিনি উক্ত ক্ষমতাবলে কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক বা কর্মচারীদের নিয়োগ, বেতন ও ভাতাদি
নির্ধারণ, চাকুরীর অবসান বা চাকুরী হইতে অপসারণ, চূড়ান্ত পাওনাদি পরিশোধ এবং প্রতিষ্ঠানের
ব্যয় অনুমোদন বা নিয়ন্ত্রণ কাজে নিয়োজিত।
শ্রম আইন ও বিধির এই সংজ্ঞাগুলোর প্রথম
অংশ সঠিক, বিপত্তি শেষ অংশে। কেন সেটা বলছি:- যেমন প্রথমাংশে বলা আছে শ্রমিক অর্থ কোন
প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে মজুরী বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক,
কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়নমূলক অথবা কেরানীগিরি কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন, এপর্যন্ত ঠিকই
ছিলো এবং এটাই হওয়া উচিৎ ছিলো কেননা যিনি মজুরীর বিনিময়ে শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক সেখানে
কে কতবড় কর্মকর্তা, কতবড় ক্ষমতার অধিকারী সেটা বিবেচ্য বিষয় হতে পারেনা। কিন্তু যখনই
বলা হলো প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তি
এর অন্তর্ভুক্ত নন তখনই এটির অপব্যবহার শুরু হলো এবং বৈষম্য দেখা দিলো।
যেমন ধরুন একটি পোশাক কারখানার একজন
সুপারভাইজার/লাইন চীফ/ইনচার্জ তিনি ২৫/৫০ টি মেশিনের উৎপাদন তদারকি করেন, উপরস্থ কর্মকর্তার
কাছ থেকে পাওয়া উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা তিনি এই মেশিনগুলোর কর্মীদের কাছ থেকে বের করে
আনেন, এখন ভাবুন তিনিও তদারকি কর্মকর্তা অথচ কোম্পানির কোনো পলিসি নির্ধারণে তার কোনো
ভূমিকা নেই, কোম্পানির একটি টাকা খরচ করার ক্ষমতা নেই অথবা অনুমতি ছাড়া খরচ করার তার
কোনো ক্ষমতা নেই এবং তিনি কায়িক পরিশ্রমী একজন ব্যক্তি এই কোম্পানির। তিনি কোম্পানির
লভ্যাংশ ভোগী নন এমনকি তার কথায় কোম্পানির কোনকিছুই নরচড় হয়না অথচ তিনি শ্রমিক নন কেননা
তাকে লিখিত অথবা অলিখিতভাবে জানানো হয়েছে তিনি তদারকি কর্মকর্তা।
আবার খেয়াল করুন একজন জেনারেল ম্যানেজার
যিনি ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর নির্দেশনায় অথবা নিজ থেকে কোম্পানির উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা
নির্ধারণ করে দেন তার অধীনস্থদের কেননা তাকে সেভাবেই কোম্পানির মালিক নির্দেশনা দিয়েছেন
এবং তিনি সেটা তদারকি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কিন্তু কোম্পানির একটি টাকা
খরচের তার কোনো ক্ষমতা নেই কোম্পানির মালিকের অনুমতি ছাড়া অথবা ক্ষমতা থাকলেও পুঙ্খানুপুঙ্খ
হিসাব দিতে হয়। তিনি কোম্পানির লভ্যাংশের কোনধরনের অংশীদার নন অথচ তিনিও শ্রমিক নন
কেননা তাকেও লিখিত বা অলিখিতভাবে জানানো হয়েছে তিনি ব্যবস্থাপনামূলক অথবা তদারকি কর্মকর্তা।
এই বৈপরীত্য দিয়ে আসলে কি করা হচ্ছে?
কিছু মানুষকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং কিছু পাওনাদি থেকে তাকে বঞ্চিত করার
চেষ্টা করা হচ্ছে এর বেশিকিছু নয় অথচ শ্রম আইন ও বিধিতে শ্রমিকদের একটি সংজ্ঞা স্পষ্ট
করা উচিৎ ছিলো, সেটি হচ্ছে “ শ্রমের বিনিময়ে যিনি মজুরী গ্রহণ করেন তিনিই শ্রমিক অথবা
মজুরীর বিনিময়ে যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক”। এখানেই শ্রমিকের সংজ্ঞা শেষ করা উচিৎ
ছিলো শুধু এতটুকু বাড়তি বলা যেতে পারতো যে “যিনি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ
ভোগী নন”।
কিছুদিন আগে যেকোনো একটি সরকারী প্রতিষ্ঠান
থেকে শ্রমিকদের চিকিৎসা সহযোগিতা পাওয়ার জন্য একটি তালিকা পাঠিয়েছিলাম যেখানে একজন
ষ্টোর অফিসার ও সুপারভাইজার এর এর নাম ছিলো। কয়েকদিন পরেই সেখানের একজন কর্মকর্তা ফোন
দিয়ে জানালেন সবাই পাওয়ার যোগ্য হলেও ষ্টোর অফিসার ও সুপারভাইজার পাবেন না কেননা তারা
শ্রমিক নন! যখন তার সাথে বিতর্কে গেলাম, তিনি তার অপরাগতা জানিয়ে বললেন “ভাই আমি জানি
আপনি শ্রম আইন নিয়ে এক আধটু পড়াশুনা করেন তাই আপনার সাথে বিতর্কে যাবোনা এক্ষেত্রে
আমার কিছুই করার নেই”। তিনি আরো বললেন “শেষ মজুরী গেজেটে যে পদবী গুলো দেয়া আছে সেগুলোর
মধ্যে থেকে নাম দেন তাহলেই পাবে আর তারাই শ্রমিক”।
যদি এই মজুরী গেজেটের কথাই ধরি, তাহলে
প্রশ্ন জাগে বর্তমানে যেসমস্ত পদ বা পদবী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান এবং যেগুলোর
বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠানে একই সেগুলো কেন মজুরী গেজেটে উল্লেখ করা গেলোনা সেটিও বোধগম্য
নয়। তাহলে কি দুটিই একই সূত্রে গাঁথা?
ভাবতে অবাক লাগে এসব শুনলে! ভাবুন একজন
ষ্টোর অফিসার বা এইচ আর অফিসার/কমপ্লায়েন্স অফিসার বা ষ্টোর ম্যানেজার বা এইচ আর ম্যানেজার/কমপ্লায়েন্স
ম্যানেজার, তিনি কোম্পানির পলিসি নির্ধারণে কতটুকু ভূমিকা পালন করেন? তিনি তার অধীনস্থ
কয়েকজনকে পরিচালনা করেন, এর বাইরে তার কোনো ক্ষমতাই নেই। যদি কেউ বলেন আছে, তাহলে বুঝতে
হবে তিনি ক্ষমতার বাহাদুর। এক্ষেত্রে যদি বলা হয় তিনি ডেস্কে বসে কাজ করেন কায়িক শ্রমী
নন সেটিও ভুল কেননা তিনি যে কাজ করেন সেটিও কায়িক শ্রমের যেমন প্রত্যেক অফিসার বা ম্যানেজার
এরই এখন ন্যুনতম একটি ডেস্কটপ কম্পিউটার আছে যেটিও একটি মেশিন এবং যেটি চালাতেও কায়িক
পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।
এরপরে যদি বলা হয় এধরণের কম্পিউটার বা
মেশিন যার চালাতে হয়না তিনি কায়িক শ্রমী নন সেটিও কিভাবে সত্য? যেমন ধরুন একজন এইচ
আর / কমপ্লায়েন্স অফিসার/ হিসাব অফিসার যিনি লেখালেখির কাজ করেন। এখন লেখালেখির কাজ
করতে কি কায়িক শ্রমের প্রয়োজন হয়না? যদি এটিও বাদ দেই তাহলে সেটি ধোপে টিকবেনা কেননা
সারা পৃথিবী জানে এবং বলছে কায়িক পরিশ্রমের চেয়ে মেধার পরিশ্রমের মূল্য অনেক বেশি।
অথচ শ্রম আইনে এই ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র কিছু লোককে ন্যায্য অধিকার
থেকে বঞ্চিত করার জন্য, কিছু ব্যক্তিকে কিছু সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার জন্য এবং
কিছু কায়েমী সার্থবাদীদের বুর্জোয়া চিন্তাধারাকে সমর্থন দেয়ার জন্য।
তাই এক কথায় শ্রমিকের সংজ্ঞা হবে –
“শ্রমের বিনিময়ে যিনি মজুরী গ্রহণ করেন তিনিই শ্রমিক অথবা মজুরীর বিনিময়ে যিনি শ্রম
দেন তিনিই শ্রমিক এবং যিনি কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ ভোগী নন”। শুধু লিখে দিলেই
হবেনা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠান এবং আইন আদালত সমস্ত জায়গায় এটিই চর্চা করতে হবে শ্রমিক
শব্দের মর্মার্থ অনুযায়ী।
কিছুদিন আগে শ্রম আইনের কিছু সংশোধনী
আনা হয়েছে। সেখানে এ বিষয়ে কোনো পরিবর্তন না থাকলেও এখন আবার শ্রম বিধিমালা সংশোধনীর
উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাই আশা করবো বিধিমালায় এই ব্যাপারটিকে পরিষ্কার করে সকলের ন্যায্য
অধিকার নিশ্চিত করা হবে এবং বৈষম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠা করা হবে।
(লেখাটি সংক্ষেপ করার জন্য অল্পকিছু
পদ পদবী এবং এক প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, আসলে সকল কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠান
এবং সুপারভাইজার থেকে জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত সবগুলো পদের কথাই বলা হয়েছে যেগুলো
সচরাচর বিভিন্ন কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে বিদ্যমান। আর লেখাটি একান্তই লেখকের নিজস্ব
মন্তব্য, যেখানে ব্যক্তিগত চাওয়া -পাওয়ার কোনো হিসেব নেই।)
Collected From : rmgtimes.com
0 Comments