শ্রম আইন নিয়ে মিথ ও নস্টালজিয়া

প্রত্যেক পেশাজীবীর নিজস্ব কর্ম-পদ্ধতি রয়েছে। তা থাকাই স্বাভাবিক।

শ্রম বিষয়ক একজন আইনজীবী হিসেবে আমার কাজের ক্ষেত্র বিস্তৃত; এর বড় অংশ হ’ল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নীতি নির্ধারণে গবেষণা-সহযোগিতা ও পরামর্শদান। এছাড়া রয়েছে নিজস্ব পড়াশোনা ও গবেষণা (বাজারে টিকে থাকার জন্য যা অত্যাবশ্যক), সহকর্মী আইনজীবীদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা ও পরামর্শদান প্রভৃতি; যা মুলতঃ আমাদের প্রোবোন কাজের অংশ।

আরেকটি কাজ আমি গুরুত্ব দিয়ে করছি- শ্রম আইন নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রশিক্ষণ করাচ্ছি, টেলিভিশনে কথা বলছি, লেখালেখি করছি- যা মূলতঃ ফেসবুকভিত্তিক পাতা The Lawyers, The RMG Times প্রভৃতিতে প্রকাশিত হচ্ছে। 

গত এক বছরে আমাদের ফেসবুক পাতা ব্যাপক সাড়া দিয়েছে; কোন কোন লেখা ২৫-২৭ হাজার মানুষের কাছে যাচ্ছে। যা আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা।

তবে এই সময়ে আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণও রয়েছে; যার সারমর্ম হ’লঃ

১। আমাদের বন্ধুদের (আইনজীবীসহ) অনেকের মত- আইন নিয়ে জনসম্মুখে “এত কিছু করার” দরকার কি। যেমন চলছে তাই চুলুক। তাঁরা মনে করেন দৈনিক আদালতে হাজিরা না দিলে কিসের আইনজীবী! আমাদের বন্ধুদের এই ধারণা ও অবস্থানের কারণ বোধগম্য।

২। বিদ্যমান বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ গৃহীত হয়েছে তার একযুগ হবে আগামী অক্টোবরে। সেইভাবে এই আইন নিয়ে আইনজীবী (যারা এইক্ষেত্রে আগ্রহী বাঃ কাজ করেন), সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী প্রমুখের মধ্যে আশাব্যাঞ্জক দক্ষতা তৈরি হয়নি। আইনজীবী ছাড়াও অন্য পেশায় দায়িত্বশীল পদে থাকা অনেকের মন্তব্য দেখে যা বোঝা যায় (অন্ততঃ ফেসবুক বা জনসমাবেশে যা পাওয়া যায়) তাও হতশাজনক। তাতে মনে হয় আইনটি অনেকে মনোযোগ দিয়ে পড়েন না বা পড়লেও বোঝেন না অথবা যারা বোঝাতে পারবেন তাঁদের সঙ্গে ওনাদের কোন যোগাযোগ নেই। আমি নতুন কোন আইনের বিরুদ্ধে নই; তবে তার আগে দেখতে হবে বিদ্যমান আইনের সমস্যা কোথায়- তা শুধুমাত্র আবেগ বা কারও চাওয়া-পাওয়ার নিরিখে দেখলে হবে না। বিদ্যামান আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়ার নিরিখে দেখতে হবে। একজন তো  মন্তব্য করেই ফেলেছেন (যা ফেসবুকে দেখলাম) “শ্রম আইন” শব্দটি ভাল শুনায় না। তাই অন্যনামে নতুন আইন চাই!!!

৩। যে কোন আইনে সীমাবদ্ধতা, ভুলত্রুটি, অস্পষ্টতা, বিধানে-বিধানে দ্বৈত অর্থ বা সংঘর্ষ থাকা স্বাভাবিক। আমাদের শ্রম আইন আগের ২৫ টি আইন রহিত করে এবং তাদের বিভিন্ন অংশ নিয়ে তৈরি। এই কাজ করতে যেয়ে যে সুসমন্বয় দরকার তা করা হয়নি। বাস্তবে একবারে তা সম্ভবও নয়। এর জন্য দরকার নির্মোহ গবেষণা এবং তার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে আইনের সংশোধন। যে সব বিষয়ে বাইরে সমাধান হবে না সেগুলো নিয়ে আদালতের দারস্থ হওয়া। দুঃখজনক হ’ল আমাদের এখানে এহেন উদ্যোগ নেওয়ার মত ব্যাক্তি ও প্রতিষ্ঠান বড় অভাব। যে সব প্রতিষ্ঠান বাজারে রয়েছে তারা ব্যস্ত অন্য কাজে! যে কাজ বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সময়সাপেক্ষ (তবে ফল সুদূরপ্রসারী) তাতে তাদের আগ্রহ কম। 

৪। আরেক প্রবণতা হ’ল- আগের আইনে কি ছিল, আইন তৈরি কিংবা সংশোধনের সময় কি কি জিনিস দাবী করা হয়েছিল তা নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন। এর হয়ত গুরুত্ব আছে; তবে তা সব সময় নয়। বরং কিভাবে বিদ্যমান আইনকে ব্যবহার করে যতদূর সম্ভব সুফল বের করে আনা যায় সে বিষয়ে মনোনিবেশ করা দরকার। আইনে কি হলে ভাল হতো তার চেয়ে বরং মনোযোগ হওয়া উচিত কোন শ্রমিক আইন-বহির্ভূতভাবে ছাঁটাই কিংবা টার্মিনেট হলে প্রতিকার কি- ক’দিনের মধ্যে অনুযোগ দিতে হবে বা মামলা করতে হবে। বিদ্যামান আইনে ও উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তবলে কি ভাবে একজন শ্রমিক সংজ্ঞার আওতায় পড়তে পারেন, প্রসূতিকালীন প্রাপ্য কি কি বা কোন ধারাবলে গ্র্যাচুইটি বিধিবদ্ধ অধিকার তা নিয়ে এই সেলফিযুগে কারও আগ্রহ নেই।  

৫। আমি আইন বিষয়ে পড়াশোনা করেছি; পরে অবশ্য সমাজকর্ম, মানবাধিকার, ব্যবস্থাপনা, মানবসম্পদ প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দেশ-বিদেশে পড়াশোনা করেছি (এবং এখনও করছি); সব ক’টি স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠান। আর আইনজীবী হিসেবে আইন ও বিচারিক প্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে অবিচল আস্থা থাকবে তাই স্বাভাবিক। আমাদের আইন, বিচারিক প্রক্রিয়া, আদালত, আইনজীবী, বিচারক-সকলেই এখানকার রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক পরিবেশে গড়ে উঠা। তাই আকাশকুসুম স্বপ্ন না দেখে বরং বাস্তবমুখী হতে হবে। এখানেও অনেক ভালো উদাহরণ রয়েছে; আমাদের মাথার উপরে। সেভাবে আমরা আমাদের সমস্যা নিয়ে আগাতে পারি; প্রকৃত সাহায্য করতে পারে এমন সহ-যোদ্ধা ব্যাক্তি-প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়।
 
৬। আমাদের অর্থনীতি ও শিল্প যেভাবে বিকাশমান তাতে অন্যান্য পেশাজীবীর সঙ্গে শ্রম-সম্পর্ক ও শ্রম আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দক্ষ পেশাজীবীর প্রয়োজন দিন দিন বাড়বে। আমরা কি সেভাবে প্রস্তুত? আমাদের নীতিনির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয়সহ জাতীয় প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংগঠনের সে দিকে মনোযোগ আছে বলে আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয় না।

৭। শ্রম আইন নিয়ে লোকজনের মধ্যে আগ্রহ বাড়ছে- এটি সত্য; বিশেষ করে যারা বেসরকারী পর্যায়ে প্রতিষ্ঠান, কারখানা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতিতে কাজ করেন তাদের মধ্যে। এটা ভাল লক্ষণ। তবে এই ক্ষেত্রে একটু সাবধান হতে বলবো। আমার পেশাগত কাজে প্রতিদিন অনেকের সংগে কথাবার্তা বা দেখা-সাক্ষাৎ হয়। অনেকে মনে করেন শ্রম আইনের বই পড়েই কিংবা নাম-সর্বস্ব দু’একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েই সব বোঝা সম্ভব। আমি তা মনে করিনা। বই পড়লেও তার সংস্করণ দেখবেন। তবে এর জন্য দরকার আরও বেশী কিছু দরকার; শ্রম আইনের ধারাকে এককভাবে দেখলে সবসময় সমধান পাবেন না। দেখতে হবে সামগ্রিক আইনি-বিচারিক প্রক্রিয়ার আলোকে। আপনার হাতে যে সমস্যা সেই বিষয়ে উচ্চ আদালত আগে কি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন (যদি থেকে থাকে) তাও আপনার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে যদি আপনার সিদ্ধান্তটিই কোন ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি চ্যালেঞ্জ করে বসেন। সহজ খোঁজা বা সংকীর্ণ দৃষ্টির ফলাফল সব সময় ভাল ফল বয়ে আনেনা।

একটি উদাহরণ দেইঃ একটি সংগঠন সম্প্রতি তাদের পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক জার্নাল (তাদের দাবী অনুযায়ী) প্রকাশ করেছে (প্রকাশকাল- সেপ্টেম্বর ২০১৭)। এতে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানী বিষয়ে ১৪ পৃষ্ঠার একটি “আর্টিকেল” রয়েছে। যার লেখক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এক শিক্ষক। এতে ২৪ টি দেশে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা কি বা তার উপাদান কি কি তা তুলে ধরা হয়েছে। রয়েছে সংশ্লিষ্ট আইনের উদ্ধৃতি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন, ২০০০ এর ১০(২) ধারার বরাতে যৌন হয়রানির উপাদান কি কি তা বলা হয়েছে। (উক্ত আইন ২০০৩ সনে সংশোধন হলে তার উল্লেখ নেই)। নেই শ্রম আইনের ৩৩২ ধারায় কি বলা হয়েছে তা।

তবে উক্ত “আর্টিকেলে” যে বিষয়ের উল্লেখ নেই তা মারাত্মক। কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করতে আমাদের মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগ এক মামলার রায়ের মাধ্যমে ২০০৯ সনে একদফা নির্দেশনা দিয়েছেন আমাদের দেশের জন্য তা এক গুরুত্বপূর্ণ আইন; যা সংশ্লিষ্টদের জন্য বাধ্যতামূলক। একটি “পিয়ার রিভিউড আর্টিকেলে” এহেন অসম্পূর্ণতা পাঠকের মধ্যে ভুল তথ্য দিবে বটে।   
            
ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট।  
(মতামত লেখকের ব্যাক্তিগত। advocateudas@gmail.com)

Post a Comment

0 Comments