এপ্রিল ১৮, ২০১৮
একটি প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন বিভাগ-প্রধানের সাফল্যের ওপর নির্ভর করে ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা সিইও’র সফলতা। সিইও সফল হলে প্রতিষ্ঠানটির মুনাফা বেশি হয়। খুশি হন শেয়ারহোল্ডাররা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সিইও’র সুনাম। প্রতিষ্ঠানের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও), কোম্পানি সচিব, চিফ কমপ্লায়েন্স অফিসার, চিফ মার্কেটিং অফিসারসহ এইচআর প্রধানরা থাকেন পাদপ্রদীপের আড়ালে। টপ ম্যানেজমেন্টের বড় অংশ হলেও তারা আলোচনার বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। অন্তর্মুখী এসব কর্মকর্তা সব সময় কেবল প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য বাস্তবায়নে ব্যস্ত থাকেন। সেসব কর্মকর্তাকে নিয়ে আমাদের নিয়মিত আয়োজন ‘টপ ম্যানেজমেন্ট’। শেয়ার বিজের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এবার এনভয় টেক্সটাইলস্ লিমিটেডের হেড অব কমপ্লায়েন্স মোহাম্মদ আল তৌহিদুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান পিয়াস
মোহাম্মদ আল তৌহিদুল ইসলাম এনভয় টেক্সটাইলস্ লিমিটেডের হেড অব কমপ্লায়েন্স। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। পরে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে মানবসম্পদের ওপর এক্সিকিউটিভ এমবিএ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট থেকে ডিপ্লোমা ইন সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। এছাড়া তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে এনভায়রনমেন্টাল গভর্ন্যান্স ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে হিউম্যান রিসোর্স কম্পিটেন্সি ম্যানেজমেন্ট কোর্স সম্পন্ন করেছেন
শেয়ার বিজ: পেশা হিসেবে কমপ্লায়েন্সকে কেন বেছে নিলেন?
মোহাম্মদ আল তৌহিদুল ইসলাম:কমপ্লায়েন্স পেশাকেই যে ক্যারিয়ার হিসেবে গড়ব, এমন কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল কাজের প্রতি আগ্রহ ছিল। খুব ভালো আর্ট করতাম। আনন্দও পেতাম। তখন থেকে স্বপ্ন ছিল আর্কিটেক্ট হবো, কিন্তু কোথাও সুযোগ পাইনি। পরে কিছুটা হতাশা নিয়েই পদার্থবিজ্ঞানে পড়ালেখা শেষ করি। কিন্তু মনের ভেতর এতদিনের লালিত স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। পাশাপাশি মানবসম্পদ বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল এবং চাকরিরত অবস্থায় মানবসম্পদের ওপর এমবিএ সম্পন্ন করি। আমি লক্ষ করলাম, কমপ্লায়েন্স হচ্ছে এমন একটি পেশা যা কিনা একটি প্রতিষ্ঠানের টেকসই ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কোম্পানিগুলো কমপ্লায়েন্স যথাযথভাবে প্রয়োগ করলে ব্যবসার ঝুঁকি কমে যায়। তাছাড়া এটি মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করে। ক্রেতার পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন এবং বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন ক্রেতার কমপ্লায়েন্সের চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে টেকসই ব্যবসার প্রসার ঘটে। তাই কমপ্লায়েন্সকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের ভূমিকা কী?
তৌহিদুল ইসলাম: অনেকে মনে করেন কমপ্লায়েন্স পেশাজীবী শুধু তার ক্রেতার অডিট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করে কোম্পানি সম্পর্কে ভালো মূল্যায়নের লক্ষ্যে কাজ করেন। কিন্তু বর্তমানে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের কাজের পরিধির বিস্তার ঘটেছে। কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার তার কোম্পানির জন্য বিজনেস কৌশলের সঙ্গে কমপ্লায়েন্স কৌশল তৈরি করেন, যেখানে তিনি অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ বিষয়ে কাজ করেন। যেমন কোম্পানির সব কর্মীর প্রতি কোনো অন্যায় বা আইনগত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেন, কোম্পানির প্রয়োজনীয় আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড স্থাপনের মাধ্যমে সুনাম বৃদ্ধি করেন। বিভিন্ন ধরনের স্ট্যান্ডার্ড প্রয়োগের মাধমে ক্রেতাদের কাছে কম্পিটিটিভ সুবিধা লাভ করেন। সর্বোপরি বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমিত ব্যবহারের মাধ্যমে কোম্পানির উৎপাদন খরচ কমিয়ে একটি টেকসই ব্যবসা সম্প্রসারণের মাধ্যমে ধারাবাহিকতা রাখেন। অর্থাৎ একজন দক্ষ কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার একটি কোম্পানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের সম্পর্ক কেমন?
তৌহিদুল ইসলাম: দক্ষ কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার আমরা তাকেই বলব যিনি তার বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপনের মাধ্যমে সবার মাঝে আস্থা অর্জন করতে পারেন। কোম্পানির সব অভ্যন্তরীণ স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে বিস্তারিত কাজের উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যার মাধ্যমে সুন্দরভাবে বিষয়গুলো প্রয়োগ করেন। অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও তিনিই সার্থক কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার, যিনি সবাইকে নিয়ে একই উদ্দেশ্যে কাজ করছেন।
শেয়ার বিজ: প্রতিষ্ঠানের কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে চাই?
তৌহিদুল ইসলাম: কোনো রফতানিমুখী প্রতিষ্ঠানে একজন দক্ষ ম্যানেজার ছাড়া কোম্পানি ভাবা যায় না। তিনি তার ক্রেতাদের সন্তুষ্টির জন্য ভূমিকা রাখেন এবং ক্রেতাদের সব ইচ্ছাকে গুরুত্ব দিয়ে কোম্পানির চাহিদা ও ক্রেতাদের চাহিদার সমন্বয় ঘটান। বর্তমানে কোনো ক্রেতা যেকোনো অর্ডারের আগে তার কোম্পানির কমপ্লায়েন্স স্ট্যাটাস দেখেন এবং ঝুঁকি মূল্যায়ন করেন, কিন্তু কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার তার কোম্পানিকে ঝুঁকির সর্বনিম্ন অবস্থানে নেওয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেন এবং ব্যবসা বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন।
শেয়ার বিজ: কর্মক্ষেত্রে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের জন্য চ্যালেঞ্জিং কী?
তৌহিদুল ইসলাম: কর্মক্ষেত্রে সবকিছু সুন্দরভাবে গোছানো থাকবে, তা আশা করাও কাম্য নয়। তাই অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও সবার সঙ্গে সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে কাজ করার ইচ্ছা হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আরও কিছু চ্যালেঞ্জ যেমন বিনিয়োগের জন্য সবাইকে একমত করা এবং দীর্ঘস্থায়ী বিনিয়োগের সম্ভাব্য অর্জন সম্পর্কে মূল্যায়ন করা। আন্তর্জাতিকভাবে দ্রুত পরিবর্তনশীল কমপ্লায়েন্সের নানা কৌশল সঠিকভাবে বোঝা এবং এ থেকে কোম্পানির প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দেখানো। সর্বশেষ মানবসম্পদ বিভাগের সঙ্গে আইন-কানুন, কোম্পানির আচরণবিধি ও আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ডের সমন্বয় ঘটানোই হচ্ছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
শেয়ার বিজ: কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার হতে হলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতা কী?
তৌহিদুল ইসলাম: একজন ডাক্তার যেমন প্রতিনিয়ত শিক্ষা কিংবা প্রশিক্ষণ ছাড়া অসহায়, ঠিক তেমনি একজন দক্ষ কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার হতে হলে তাকে অবশ্যই ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের চাহিদার সঙ্গে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ কিংবা শিক্ষা গ্রহণ এবং তার যথার্থ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর আমার মতে শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে মানবসম্পদের ওপর পড়াশোনা থাকলে ভালো হয়। বর্তমানে বিজ্ঞান ও মানবসম্পদের যোগ্য লোকেরাই সফলতা পাওয়ায় ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। কারণ কমপ্লায়েন্স একটি মাল্টি ফাংশন এরিয়া যেখানে বিজ্ঞান, মানবসম্পদ ও আইন বিষয়াদি অনেক প্রয়োগ হয়। প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে কমপ্লায়েন্স পেশাজীবীদের জন্য ডিগ্রি যেমন ডিপ্লোমা ইন স্যোশাল কমপ্লায়েন্স, বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড লিড অডিটর, নানা ধরনের পরিবেশগত বিষয়ের কোর্স সার্টিফিকেট, বিভিন্ন মানবসম্পদের কোর্স সার্টিফিকেট পেশাগত দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করে।
তাকে অবশ্যই যোগাযোগ দক্ষতায় ভালো হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ নেগোশিয়েটর হতে হবে এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে হিসাবরক্ষণাবেক্ষণের জ্ঞান থাকা জরুরি।
তাকে অবশ্যই যোগাযোগ দক্ষতায় ভালো হওয়ার পাশাপাশি দক্ষ নেগোশিয়েটর হতে হবে এবং অর্থনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে হিসাবরক্ষণাবেক্ষণের জ্ঞান থাকা জরুরি।
শেয়ার বিজ: আমাদের দেশে এ পেশার সম্ভাবনা কেমন বলে মনে করেন?
তৌহিদুল ইসলাম: এই পেশার সম্ভাবনা উজ্জ্বল। আমাদের দেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এজন্য যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে রফতানিমুখী শিল্প ও পোশাক খাতের। আর এই অবস্থানে আসার জন্য কমপ্লায়েন্স পেশাজীবীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আমার মতে এ পেশায় আরও অনেক বিস্তার ঘটার সম্ভাবনা আছে এবং এটি একটি সম্মানজনক পেশাও বটে। তবে আমাদের দেশে এখনও যোগ্য ব্যক্তির অভাব রয়েছে।
শেয়ার বিজ: পেশা হিসাবে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
তৌহিদুল ইসলাম: পেশা হিসেবে কমপ্লায়েন্স ম্যানেজারের পদ যেমন চ্যালেঞ্জিং তেমনি সম্মানের। একইসঙ্গে আত্মতৃপ্তিরও বটে। কারণ ব্যবসায়িক কৌশলের কারণে কোম্পানির ব্যবসা সম্প্রসারণে অংশদারিত্ব থাকে।
শেয়ার বিজ: সফল কমপ্লায়েন্স ম্যানেজার হতে হলে কী কী গুণ থাকা জরুরি?
তৌহিদুল ইসলাম: প্রথমত, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রাখা যাবে না। অবশ্যই উপযুক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হতে হবে। সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। কাজের চাপ নেওয়া ও সহ্য করার ক্ষমতা থাকতে হবে। যে কোনো পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে। সুন্দর ব্যক্তিত্বের অধিকারী এবং একইসঙ্গে সৎ ও নিষ্ঠাবান হতে হবে।
0 Comments