আমরা যারা নিজেদেরকে ব্যক্তিজীবন ও পেশাগত জীবনে সফলতার উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই, তাদের জন্য SWOT Analysis অপরিহার্য একটি বিষয়। মহান দার্শনিক সক্রেটিসের অসাধারণ একটি উক্তি আছে, “Know Thyself” অর্থাৎ নিজেকে জানো। নিজেকে জানার এই কাজটি SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমেই সম্ভব। SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে নিজের শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলো খুব ভালোভাবে জেনে, জীবনকে আরো সুন্দরভাবে সাজানো যায়, রাঙানো যায়। বর্তমানে আমি কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই, কিভাবে যেতে চাই SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে তা অর্জন করা সম্ভব। SWOT এর সম্পূর্ণ অর্থ হচ্ছে :
- S – Strengths (শক্তি)
- W – Weakness (দুর্বলতা)
- O – Opportunities (সুযোগ/সম্ভবনা)
- T – Threats (হুমকি)
এর মধ্যে শক্তি ও দুর্বলতা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ বিষয় এবং সুযোগ ও হুমকি হচ্ছে বাইরের বিষয়। SWOT অ্যানালাইসিস মূলতঃ করা হয় ব্যবসায়িক বা প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা অর্জন ও হুমকি দূর করার জন্য। তবে ব্যক্তি জীবনের ক্ষেত্রেও একই সূত্র ব্যবহার করে সফলতা অর্জন সম্ভব। আজকে সে বিষয়টি নিয়েই আলোচনা করবো।
শক্তি : জীবনের লক্ষ্যে এগিয়ে চলার জন্য, প্রথমে ব্যক্তির শক্তির দিকগুলো কি কি আছে তা শনাক্ত করে একটি কাগজে লিখে ফেলতে হবে। তারপর ওই শক্তির দিকগুলোকে প্রতিদিন চর্চার মাধ্যমে আরো বেশী শাণিত করতে হবে, যাতে প্রতিনিয়ত ব্যক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। মনে রাখতে হবে, দক্ষতা বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, আর আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির সাথে সাথে, মানুষের নিকট তার গ্রহণ যোগ্যতাও প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকে। যেমন কোন মানুষের শক্তির দিকগুলো হতে পারে — তিনি কমিউনিকেশন এ খুব ভালো, তার মধ্যে ভালো নেতৃত্ব গুণ আছে, দায়িত্ব নিতে সব সময় আগ্রহী, খুব চাপের মধ্যে থেকেও ভালো কাজ করতে পারেন, প্রতিদিন নতুন কোন না কোন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন, ভালো ইংরেজি বলতে পারেন, কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজে দক্ষতা খুবই ভালো ইত্যাদি। এরকমভাবে ব্যক্তি যখন তার শক্তির সকল দিকগুলো শনাক্ত করে ফেলবেন, তখন তিনি নিজেই তাকে খুব সহজে এবং সুন্দরভাবে মূল্যায়িত করতে পারবেন। আর শক্তির এই দিকগুলো প্রতিনিয়ত চর্চার মাধ্যমে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। আর এভাবেই, ব্যক্তির শক্তির দিকগুলোকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে হুমকিগুলোকেও সুযোগে পরিণত করা যায়।
দুর্বলতা : কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয় সব বিষয়ে দক্ষ হওয়া, সবারই কোনো না কোনো জায়গায় দুর্বলতা বা ভয় থাকে। যে দুর্বলতাগুলো বা ভয়ের কারণেই জীবনের গতি থমকে যেতে পারে। সেই দুর্বল/ভয়ের দিকগুলো খুঁজে বের করে, বেশি বেশি কাজ করতে হবে ওই দুর্বলতা/ভয়গুলো নিয়ে, যাতে করে দুর্বলতা/ভয়গুলোও এক সময় শক্তিতে পরিণত হয় বা দুর্বলতা/ভয়গুলো ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে। যে কোনো একটি দুর্বলতা বা ভয় অনেকগুলো শক্তিকে ব্যর্থতায় রূপান্তরিত করতে পারে! জীবনের গতিকে থামিয়ে দিতে পারে! তাই আমার দুর্বলতা/ভয়ের কারণে আমার জন্য কি কি হুমকি অপেক্ষা করছে এবং আমার জীবনের কি কি সুযোগ হাত ছাড়া হয়ে যাবার সম্ভবনা আছে তা লিপিবদ্ধ করতে হবে। তারপর পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে, ওই নির্দিষ্ট দুর্বলতা/ভয়গুলোকে কাটিয়ে ওঠার জন্য আমাকে কত দিন পরিশ্রম করতে হবে, এর জন্য আমাকে কি কি জিনিস বিসর্জন দিতে হবে। এখানে অবশ্যই একটি জিনিস মনে রাখতে হবে, কখনোই এই পরিশ্রম এবং বিসর্জনকে যন্ত্রণা হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না বরং লক্ষ্য অর্জনের আকাঙ্ক্ষায় এই পরিশ্রম এবং বিসর্জন হবে অনুপ্রেরণার উৎস। যেমন কোন মানুষের দুর্বলতার দিকগুলো হতে পারে — তিনি মানুষের সাথে সহজে মিশতে পারেন না, অনেক মানুষের সামনে কথা বলতে ভয় কাজ করে বা চিন্তা করেন লোকে কি ভাববে, অনেকগুলো কাজ একসাথে চলে আসলে নার্ভাস হয়ে যান, প্রতিদিন নতুন কিছু শিখার জন্য সময় বের করতে পারেন না, শুধু নিজেকে এই বলে সান্তনা দেন যে, “অন্য সময় শিখবো”, যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতার অভাবে সামনে এগিয়ে যেতে পারছেন না, ভালো ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারেন না, কম্পিউটার সংক্রান্ত কাজের দক্ষতা ভালো নয় ইত্যাদি। যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণের মাধ্যমে সীমাবদ্ধ সময় থেকে যেভাবেই হোক সময় বের করে নিজের যোগ্যতা বৃদ্ধি করে, দুর্বলতার এই দিকগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব কাটিয়ে উঠতে হবে। নতুবা অনেকগুলো গুণ থাকার পরেও শুধুমাত্র হয়তো ভালো ইংরেজি বলতে না পারার কারণে অথবা যথাযথ শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকার কারণে অথবা এরকম যেকোন একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্বলতা/ভয়ের কারণে জীবনের অগ্রগতি থমকে যেতে পারে!
সুযোগ: প্রতিটি মানুষের জীবনেই কোন না কোন সময়, একটি ভালো কিছুর সম্ভবনা উকি দেয়। তখন শুধু যথাযথ দক্ষতা বা যোগ্যতার অভাবে, সে সুযোগটি অনেকেই গ্রহণ করতে পারেন না। তাই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য, নিজের শক্তির দিকগুলোকে সব সময় বৃদ্ধি করতে হবে, দুর্বলতাগুলোকে হ্রাস করতে হবে এবং তা করতে হবে সচেতনভাবে পরিকল্পনামাফিক।
মানুষ জীবনে অনেক সময়ই হতাশ হয়ে পড়ে, তার সৃষ্ট দুর্বলতাগুলোর কারণে যখন জীবনের কাঙ্ক্ষিত সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে না। তখন তিনি বরং পেশাগত জীবনে হুমকির সম্মুখীন হন অর্থাৎ তার পেশাগত উন্নতি তখন থমকে যায়! যেমন, চাকুরীর বয়স বেশি হওয়ার পরও, পরবর্তী পদোন্নতির জন্য একজন মানুষের মধ্যে যেরকম যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা প্রয়োজন তা না থাকার কারণে তুলনামূলকভাবে বয়সে নবীন কেউ পদোন্নতি পেয়ে যান। তাই পেশাগত এই সুযোগকে কাজে লাগানোর জন্য আমার সহকর্মীদের চাইতে আমাকে গুনে ও মানে সেরা হতে হবে। এজন্য আমাদের মধ্যে সব সময় একটি পজিটিভ প্রতিযোগিতা থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির নিজের সৃষ্ট দুর্বলতাগুলোর কারণে, পেশাগত উন্নতির সুযোগ থমকে যায়। তাই যত দ্রুত সম্ভব প্রথমে নিজের দুর্বলতাগুলোকে খুঁজে বের করতে হবে এবং পরিকল্পনামাফিক সেই দুর্বলতাগুলোকে ধীরে ধীরে কাটিয়ে উঠতে হবে এবং শক্তিতে পরিণত করতে হবে। তবেই আমরা নিজের পেশাগত জীবনের জন্য প্রাপ্ত সুযোগ কাজে লাগাতে পারবো। আমি আবারো বলছি সব সময় নিজেকে প্রশ্ন করতে হবে আমি কোথায় যেতে চাই? কিভাবে যেতে চাই? এবং লক্ষ্যে পৌছানোর পর আমার জীবন কি রকম সুন্দর ও অর্থবহ হবে! সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে নিজেকে প্রতিনিয়ত তৈরি করে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যেমন – কোন একজন ব্যক্তি অর্থনীতির বিষয়গুলো পড়তে ভালোবাসেন। কিন্তু হতে চান একজন ডাক্তার! এক্ষেত্রে অবশ্যই তার শক্তির দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। নতুবা জীবনে অনেক সুযোগ ও আনন্দ হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে! অর্থাৎ ব্যক্তি যে বিষয়ে দক্ষ বা পড়তে ভালোবাসেন সে বিষয়ে সাধনা করলে তিনি যেরকমভাবে কাজ করে আনন্দ পাবেন তেমনিভাবে সফলতাও তার জীবনে খুব সহজে ধরা দেবে। আর তখন কোন কষ্টের কাজ তার নিকট কষ্টের মনে না হয়ে, বরং তা হবে আনন্দের উৎস। জীবনে যখন ব্যক্তির শক্তির দিকগুলো বৃদ্ধি পায়, তখনই তার সামনে বিভিন্ন সুযোগ এসে হাতছানি দেয়। ব্যক্তি জীবনে সুযোগ বা সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগানোর জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আসা জরুরী:
১। নতুন কোনো
প্রযুক্তি বা বিষয় সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা।
২। আপনার প্রতিষ্ঠানে এখন যে বিষয়টির প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে, যত
দ্রুত সম্ভব সে বিষয়ে নিজের জ্ঞান বৃদ্ধি করা।
৩। যদি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ আপনার সহকর্মী সঠিকভাবে সম্পাদন করতে না পারেন,
তাহলে তাকে সহায়তা করুন,
আপনার গুরুত্ব তৈরি হয়ে যাবে এবং সময়ে এটা প্রকাশ পাবেই।
৪। আপনার প্রতিষ্ঠানের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ কি আছে যা অন্য কেউ সম্পাদন করতে
পারছেন না? যদি
তা আপনি করতে পারেন, তবে আপনি হয়ে উঠবেন প্রতিষ্ঠানের একজন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ
ব্যক্তি।
এভাবেই নিজের ভালো লাগার জায়গায় মানুষ যদি কাজ করে যেতে পারে, তবে জীবনে অসংখ্য সুযোগ আসবে ব্যক্তির সামনে আর সফলতাও ধরা দিবে অবধারিতভাবে।
হুমকি : মানুষের দুর্বলতাগুলো তার ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। যেমন কেউ যদি কোন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার স্বপ্ন দেখেন আর তার যদি ইংরেজিতে কথা বলায় দুর্বলতা থাকে তাহলে স্বপ্নের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারে যেতে পারবেন না কিংবা যদি ওই ক্যারিয়ারের যোগও দেন পরবর্তীতে বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে যোগাযোগ সমস্যার সম্মুখীন হবেন। তাই নিজের সম্পর্কে পূর্ব ধারণা নিয়ে, সে অনুযায়ী নিজেকে এখন থেকেই প্রস্তুত করতে হবে, যেন ভবিষ্যতে কোনো সমস্যায় পড়তে না হয়। হুমকি মোকাবেলার জন্য নিচের বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আসা জরুরি:
১। পেশাগত
জীবনে ভালো করার জন্য মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে আগে থেকেই নিজেকে খুব
ভালোভাবে তৈরি করুন।
২। পেশাগত জীবনে বর্তমানে আপনি কি কি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা শনাক্ত করে খুব
দ্রুত তার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে, সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য।
৩। আপনার কোন কোন দুর্বলতার জন্য, আপনার সহকর্মীদের তুলনায় পেশাগত জীবনে আপনি
পিছিয়ে পড়ছেন, তা শনাক্ত করে দ্রুত সমাধানের পথ খুঁজে বের করুন।
এভাবে SWOT Analysis এর মাধ্যমে ব্যক্তি, নিজের জীবনকে আয়নার মত দেখতে পাবেন। জীবনের বাধা – প্রতিবন্ধকতাগুলো অতি সহজেই মোকাবেলা করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো ব্যক্তির জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে নিজেকে শানিত করার এই কাজটি (SWOT Analysis) খুব কম লোকই করেন। আর সময় গড়ানোর সাথে সাথে শুধু নিজের কপালের/ভাগ্যের দোষ দিতে থাকেন অথবা বলতে থাকেন আমার মামা – কাকা কেউ নেই বলে আমার জীবনের উন্নতি হচ্ছেনা!! প্রতিযোগিতামূলক এ বিশ্বে দক্ষ ও ভালো লোককে সবাই খুঁজে। কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া দক্ষ ও ভালো লোক নিজেরাই তাদের অবস্থান তৈরি করে নেন। আমাদের চারপাশে এরকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। তাই আসুন এতদিন যা হবার হয়েছে! আজ থেকে SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে গুরুত্ব অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে জীবন যাপন করে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেকে ভালোভাবে জেনে, আত্মবিশ্বাসী হয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। সবাই যেখানে পৌঁছায় ১০ বৎসরে, SWOT অ্যানালাইসিস এর মাধ্যমে আমি সেখানে পৌঁছাবো ৫ বৎসরে এবং এটাই হতে হবে আমার সংকল্প। পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যেতে পারলে, ইনশাল্লাহ সফলতা আসবেই।
0 Comments