পেশাগত জীবনে সামনে এগিয়ে যেতে এবং উত্তরোত্তর সফলতার জন্য জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নেই। বিশ্বায়ন এবং প্রতিযোগিতার যুগে একমাত্র প্রতিনিয়ত জ্ঞান অর্জনই পারে একজন পেশাজীবিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। আধুনিক কালে পেশাগত জীবনে পেশা নির্ভর জ্ঞান অর্জন এবং বাস্তব কর্ম পরিবেশে তা প্রয়োগ করতে পারলে একজন কর্মজীবি মানুষ, দক্ষ পেশাজীবিতে রুপান্তরিত হয়।
ছোট বেলায় আষাঢ় মাসে বৃষ্টির দিনে আমরা যখন বাহিরে যেতে পারতাম না তখন আমাদের পরিবারের বড়দের কাছে অনেক মজার মজার গল্প শুনতাম। এ গল্প গুলো ছিল অনেক মজার। গল্পের মূল চরিত্রের নায়ক পারে না এমন কিছু নাই। পৃথিবীতে যেসব অকল্যানকর বিষয় আছে নায়ক তা যেমনি মোকাবিলা করে ঠিক তেমনি পৃথিবীর বাহিরের যত রাক্ষস খোক্ষস সহ অকল্যানকর বিষয় আছে সবই মোকাবিলা করে যাবতীয় অকল্যানকর বস্তুসমূহ ধংসের মাধ্যমে পৃথিবী ও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে। বাস্তবতা বিবর্জিত এমন অবিশ্বাস্য কাহিনী ভিত্তিক গল্পগুলো আমাদের সমাজে আষাঢ়ে গল্প নামে পরিচিত।
আমরা ছোট বেলায় এগল্পগুলো শুনে অনেক রোমাঞ্চিত হতাম, মাঝে মাঝে নিজেকে গল্পের নায়কের সাথে তুলনা করতাম, ভাবতাম গল্পের নায়েকের মত আমারও অনেক ক্ষমতা, সব অতিমানবীয় বিষয় আমাকে দিয়েই সম্ভব, আমি পারিনা এমন কি কিছু আছে। বড় হয়ে বুঝতে পারলাম আমি পারিনা এমন অনেক কিছু আছে, আমার ভিতর যেমন অনেক সম্ভাবনা আছে, তেমন অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে।
বড়বেলায় পেশাগত জীবনে সমস্যা হল এখন আমরা অনেকে তাত্বিক ও বাস্তব বিষয় সমুহ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের নামে বাস্তবতা বিবর্জিত, তত্ব জ্ঞানহীন অথবা অসম্পুর্ন তত্ব জ্ঞান নিয়ে এর সাথে নিজের ব্যক্তিগত জীবনের মূল্যবোধ, নৈতিকতাকে রং চং মাখিয়ে আষাঢ়ে গল্পে রূপান্তর করে উপস্থাপিত করতে বা উপস্থাপিত বিষয় শুনতে পছন্দ করি। এসব বিকৃত ব্যাখ্যা অনেকে নিজে অনুসরণ করে এবং অন্যদের অনুসরনে অনুপ্রাণিত করতে বিভিন্ন জায়গায় উপস্থাপন করে।
আবার অনেক পেশাজীবি তাত্বিক ও বাস্তব বিষয় সমুহ যৌক্তিক এবং নৈব্যক্তিক ভাবে উপস্থাপনের চেয়ে আষাঢ়ের গল্পের নায়কের মত নিজের পদ, পদবি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, বিভিন্ন কমিটির সংশ্লিষ্টতাকে বড় করে উপস্থাপন করে, যেন ভাবখানা এমন আমার পদবি এই, আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা এই, আমি এই কমিটিতে সংশ্লিষ্ট ছিলাম বা আছি। অতএব যেহেতু আমি এটা বলেছি, সেহেতু এটার যৌক্তিকতা বিচারের কোন সুযোগ নাই, বিনা বিচারে মেনে নিতে হবে, অনেকটা রাজতান্ত্রিক ধাচের ভাব। এখনে বিড়াল ইদুর ধরেছিল কিনা সেটা আলোচ্য বিষয় নয়, আলোচ্য বিষয় হচ্ছে বিড়ালটি সাদা নাকি কালো।
আবার আরো এক শ্রেণির পেশাজীবি আছে যারা তাত্বিক ও বাস্তব বিষয় সমুহ যৌক্তিক এবং নৈব্যক্তিক ভাবে উপস্থাপনের চেয়ে আষাঢ়ের গল্পের নায়কের মত অযৌক্তিক দলাদলি করতে পছন্দ করে এবং দলাদলি করে নিজেদের অযৌক্তিক মতামত সংশ্লিষ্ট বিষয় সর্ব উত্তম মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট থাকে। এরা নিজেকে প্রাণী জগতের এক বিশেষ শ্রেণীর প্রাণী হিসেবে কল্পনা করতে পছন্দ করে। এদের আবার কিছু অন্ধ অনুসারী আছে, যারা পেশাগত জীবন এদের অনুসরনে অন্ধ থেকে আরো অন্ধত্বের দিকে ধাবিত হয়।
কোন মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়, পেশাগত জীবনে ভুল হতে পারে, ভুলটা যদি দুই, এক বার হয় এবং অনিচ্ছাকৃত ভাবে হয় তবে তা মার্জনীয়। যদি দেখা যায় একজন ব্যক্তি ভুলের পর ভুল করতে থাকে, আবার নিজের ভুল বুঝতে পারলেও তা সংশোধনের কোন ইচ্ছা নেই, উপরন্তু নিজের ভুল শুদ্ধ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে আরও অনেক ভুলের জম্ম দেয় এবং নিজেকে আষাঢ়ে গল্পের নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাহলে আমাদের বুঝতে হবে এ ধরনের ব্যক্তির ভুলের পিছনে নিন্মোক্ত দুটি কারন, বা দুটির যে কোন একটি হতে পারে, যেমন-
প্রথমটি হল তার অর্জিত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের সনদ সমূহ তাকে শিক্ষিত ও আচরনগত পরিবর্তন করার নিশ্চয়তা অনুসারে শিক্ষিত ও মার্জিত করতে পারেনি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোথাও একটা গড়মিল ছিল তাই একজন ব্যক্তির পেশাগত সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্টি।
দ্বিতীয়টি হল নিজে সচেতন ভাবে ইচ্ছেকৃত ভুল করে নিজের মনের অবচেতন কোন ইচ্ছা বাস্তবায়নে কাজ করে। পেশাগত জীবনে ভুলে ভরা বা সচেতন ভাবে ইচ্ছাকৃত ক্রমান্বয়ে ভুল করে যাওয়া কোনটিই গ্রহণ যোগ্য নয়।
একজন উচ্চস্তরের পেশাজীবির ভুল, শুধু তার একার ভুল নয়, কারন একই ভুল তার অনুসারীগন শুদ্ধমনে করে অনুশীলন করতে থাকে এবং এটা একটা দলবদ্ধ লোকের ভুলে রুপান্তর হয়। তাই যে যত বড় পেশাজীবি, তার পেশা ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতাও ততবেশি।
আমাদের পেশাগত কর্মপরিবেশে বাস্তবায়নযোগ্য অনেক বিষয় নিয়ে বিভিন্ন ধরণের মতামত ও যুক্তিতর্ক আছে। পেশাটি যদি হয় মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, তবে এর মূল ভিত্তি দাড়িয়ে আছে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা আইন তথা শ্রম আইনের উপর, আর এটি নিয়ে আরো বেশী মতামত ও তর্কবিতর্ক থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
এখানে উল্লেখ্য যে ফৌজদারী আইন নিয়ে পুলিশ প্রশাসন এবং আইনজীবি দুই শ্রেনীর পেশাজীবি কাজ করে, পুলিশ প্রশাসন সমাজে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করে আর আইনজীবিগন আদালতে এর প্রয়োগের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিচার নিশ্চিত করে, তেমনি শ্রম আইন নিয়ে দুই শ্রেনীর পেশাজীবি কাজ করে, মানব সম্পদ পেশাজীবি এবং আইনজীবি। মানব সম্পদ পেশাজীবিগন প্রতিষ্ঠানে এর প্রয়োগ নিশ্চিত করে আর আইনজীবিগন আদালতে এর প্রয়োগের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিচার নিশ্চিত করে। শ্রম আইন নিয়ে উক্ত দুই শ্রেনীর পেশাজীবি কাজ করে বিধায় এর বিচার বিশ্লেষনেও এই দুই শ্রেনীর দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হতে হয় অন্যথায় এর প্রয়োগ বান্তবতা বিবর্জিত হয়।
বাংলাদেশের শ্রম আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক যৌক্তিক ও অযৌক্তিক তর্কবিতর্ক পরিলক্ষিত হয়। অনেক পেশাজীবি শ্রম আইনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে খন্ডিত, অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক এবং নিজের ব্যক্তিগত জীবন দর্শন, নৈতিকতা আইনের সাথে মিশিয়ে ব্যাখ্যা দেয়। অনেক পেশাজীবি আবার আষাঢ়ে গল্পের প্রবক্তাদের মত এধরণের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ কারীদের পছন্দ করেন ।
"শ্রম আইনে আষাঢ়ে গল্প" যারা বলছে এবং যারা শুনছে এবং যারা মজা নিচ্ছে তাদের সকলের পেশাগত জীবনও আষাঢ়ে গল্পে রুপান্তরিত হচ্ছে।
শ্রম আইন সংশ্লিষ্ট অনেক পেশাজীবি শ্রম আইনের ব্যাখ্যা মনের মাধুরী মিশিয়ে এমন ভাবে দেয়, যেন ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মালিকের পকেট থেকে শ্রমিকের পকেটে কিছু টাকা নিয়ে দিতে পারলে তারা মনে করেন অনেক বড় ন্যায়বিচার করে ফেলছেন। তারা কখনো এ কথা চিন্তা করেন না যে, কারো কল্যান করতে হলে নিজের পকেটের টাকা দিয়ে করতে হয় অন্যের পকেটের টাকার উপর তার কোন অধিকার নাই। ট্রাষ্টি হিসেবে কোন চেয়ারে বসে বিচার বিশ্লেষণ করার নামে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কাউকে ঠকানো আর কাউকে জিতানো দিয়ে আর যাই হোক ন্যায় বিচার হয় না বরং ন্যায়বিচারের নামে নিজের নামটা ধান্দাবাজদের তালিকায় সংযুক্ত করা হয়।
আইনকে আইনের মত ব্যাখ্যা করতে হবে, নিজের মত ব্যাখ্যা করার সুযোগ নেই, আইনের ব্যাখ্যা হতে হবে নৈব্যক্তিক, এখানে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া বা নৈতিকতা সংমিশ্রনের সুযোগ নেই।
শ্রম আইনের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই কিছু কিছু পেশাজীবি নিজেদের মতামত আইনের ব্যাখ্যা বলে চালিয়ে দেয়, এই শ্রেনীর বেশী ভাগ লোক আবার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অংশ, এদের পদবী দেখলে বুঝা যায় এরা কখনো প্রতিষ্ঠানে উপদেষ্টা পদে, কখনো ব্যবস্থাপকীয় অথবা কখনো তত্বাবধায়ক পদে কর্মরত আছেন। পেশাগত জীবনের যে শপথ অর্থাৎ সততার সাথে দায়িত্ব পালন করার কথা তা আর হয় না, পারিশ্রমিক নেয় প্রতিষ্ঠানে মালিকের অংশ হয়ে ভুমিকা নেয়ার, আর নিজের অজান্তে পেশার সাথে ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া মিশিয়ে নিজের চেয়ারে বসে ট্রাষ্টিশীপের কথা ভুলে গিয়ে এমন ভুমিকা নেয়, পুরোটা চলে যায় মালিকের স্বার্থের বিপরীতে। পেশাজীবিদের এধরনের ভুমিকা প্রতিষ্ঠানে স্বার্থের যেমন পরিপন্থি তেমন একই ধরনের পেশায় যারা কর্মরত আছেন তাদের জন্যও বিব্রতকর।
আমির খান অভিনীত হিন্দি চলচ্চিত্র পিকে এর পরিচালক ও গল্পকার রাজকুমার হিরানী উক্ত চলচ্চিত্রে বাস্তব জীবনে রং নাম্বার বলে একটা বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছিলেন। রং নাম্বার দ্বারা উক্ত চলচ্চিত্রে বুঝনোর চেষ্টা করা হয়েছে আমাদের সমাজে এমন অনেক চরিত্র আছে যারা তাদের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়া ও ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করা এবং বৈষয়িক সুযোগ সুবিধা লাভের উদ্দেশ্যে একটি বিষয়কে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করে যাতে উক্ত বিষয়টি মূল উদ্দেশ্যে ব্যাহত হয় এবং বিষয়টি সঠিক পথে পরিচালিত না হয়ে ভুল পথে পরিচালিত হয়। সমাজে বিভিন্ন বিষয় এধরণের ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে ভুল পথে পরিচালনা কারীদের তিনি রং নাম্বার বলে অভিহিত করেছিলেন।
আমাদের পেশাগত জীবনে এমন কিছু পেশাজীবির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটে যাদের জ্ঞানের স্বল্পতা অথবা ব্যক্তি জ্ঞানী কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের নৈতিক দর্শন সংমিশ্রনে বিভিন্ন তাত্বিক বিষয় ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এমন ভাবে উপস্থাপন করে যেন আমরা আষাঢ়ে গল্প শুনছি।
আষাঢ়ে গল্পের মত যারা তাত্বিক বিষয় সমূহ ভুল, অবিশ্বাস্য ও বাস্তবতা বিবর্জিত ব্যাখ্যা দেয় তারা আসলে পেশাজীবি সমাজের জন্য এক একজন, এক একটা রং নাম্বার। আমরা যদি আমাদের পেশাগত জীবনে এসব রং নাম্বার সনাক্ত করতে না পারি এবং এদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ছোট বেলার মত পেশাগত তাত্বিক বিষয় সমূহ হতে আষাঢ়ে গল্পের মত মজা নিতে বসে থাকি তবে আমাদের পেশাগত জীবনও একটা আষাঢ়ে গল্পে রূপান্তরিত হবে এবং আমরাও একদিন পেশাজীবি সমাজে রং নাম্বারে পরিনত হব। আমরা কি চাই আমাদের পেশাগত জীবন আষাঢ়ে গল্পে রূপান্তর হোক অথবা আমরা একটি রং নাম্বারে রূপান্তর হয়। যদি না চাই তাহলে পেশাগত জীবনে আষাঢ়ে গল্প বলা লোক বা রং নাম্বারদের বাছাই করে এদের এড়িয়ে চলায় আমাদের দায়িত্ব।
লেখক:
মোহাম্মদ বাবর চৌধুরী,
এডভোকেট এন্ড এইচ. আর প্রফেশনাল।
সহযোগীতায়ঃ
ইমরুল হাসান (Emrul Hasan),
এইচ. আর প্রফেশনাল
প্রকাশকঃ বাবর এন্ড এসোসিয়েটস্
প্রকাশ কাল- ২৭/০৫/২০২০
0 Comments