করোনা ভাইরাস (কোভিড- ১৯) মহামারী আকারে প্রাদুর্ভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী
থমকে দাড়িয়েছে জনজীবন, বন্ধ হয়েছে সকল অফিস আদালত ও কলকারখানাসহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। আমাদের দেশেও করোনা ভাইরাসের
প্রাদূর্ভাবে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়েছে বা হয়ে যাচ্ছে। শিল্প কারখানা গুলোর
ভবিষ্যত অস্তিত্ব ধরে রাখতে তাদের পুজি ধরে রাখার চিন্তা যেমন মালিক পক্ষের আইন
সঙ্গত, তেমনি শ্রমিক পক্ষ মহামারী কালীন কাজ না করে ঘরে
অবস্থান করে নিজের জীবন ধারণ এবং অস্তিত্ব রক্ষায় ন্যূনতম চাহিদা পূরনে প্রতিষ্ঠান
তাদের পাশে থাকবে এমন চিন্তা করাটাও যৌক্তিক এবং আইন সঙ্গত।
আমাদের দেশে বর্তমান মহামারী প্রাদুর্ভাবের পর আমরা বিষয়টি নিয়ে বিতর্কে
জড়িয়ে গেছি এ ধরনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠান বন্ধকালীন সময় উৎপাদনের উপকরন হিসেবে
শ্রমের প্রধান নিয়ামক শ্রমিক রক্ষায় মালিকের দায়িত্ব কি বা শ্রমিকের অধিকার কি। আমাদের
শ্রম আইনে এমন প্রেক্ষাপটে মালিক ও শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে যে নীতির কথা
বলেছেন তা হল প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং শ্রমিকদের জীবন ধারন ও ন্যূনতম চাহিদা
পূরনে লে-অফ নীতি অনুসরণ করে তাদের মজুরীর পরিবর্তে ক্ষতিপূরন পরিশোধ করা। আমরা
অনেক সময় কিছু শ্রমিক নেতাদের দেখি যারা জাতির এমন দুঃসময়ে অসংযত কথা বলে, কাজ না করে ঘরে বসে শ্রমিকদের
সম্পূর্ণ মজুরী পরিশোধ দিতে বলে, পক্ষান্তরে কিছু মালিক
পক্ষের লোকদের দেখা যায় শ্রমিক কাজ করবে না বিধায় কোন পরিশোধ দিতে অপারগতা প্রকাশ
করেন, অনেকে আবার অতি উৎসাহিত হয়ে প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘদিন
কাজ করা শ্রমিকদের এমন দুঃসময়ে ছাটাই করা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। জাতির এমন
দুর্যোগের সময় এ ধরনের আচরণ বাঞ্চণীয় নয়। অতীতে জাতীয় দূর্যোগ আমরা বাংঙ্গালিরা
যেমন সবাই সম্মিলিত মোকাবিলাভাবে করেছি তেমনি বর্তমান সময়ও আমাদের উচিত মালিক ও
শ্রমিক একত্রিত হয়ে এ দূর্যোগ মোকাবিলা করা। আমাদের মনে রাখতে হবে মালিক যদি
দূর্যোগ মোকাবিলায় সকল পুঁজি হারায় তাহলে প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হবে, আর প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হলে শ্রমিক হারাবে তার কর্মসংস্থান এবং জাতি
হিসাবে আমরা হয়ে পড়ব আর্থিকভাবে দেওলিয়া পক্ষান্তরে শ্রমিক যদি দূর্যোগ মোকাবিলায়
তার জীবন ও অস্তিত্ব হারায় তবে মালিকের পুঁজি থেকে লাভ কি? কারন পুঁজি থাকলেও শ্রমিক ছাড়া মালিকের প্রতিষ্ঠান অচল। তাই এমন
অবস্থায় শ্রমিক মালিক সকলের স্বার্থে আইন বলছে প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে আর মালিক
শ্রমিককে লে-অফ নীতি অনুসরণ করে ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে।
যদি একটি প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট সময় বন্ধ থাকে তবে, সেক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ
হলো তার প্রক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের পাওনা কি হবে তা বাংলাদেশ
শ্রম আইনে উল্লেখ আছে। আমরা জাতি হিসেবে মানবীয় সমাধান মানবীয় ভাবে না খুজে
অতিমানবীয় ভাবে খুজি। এখানে মালিক পক্ষ বা শ্রমিক পক্ষ নিজেকে মানব হিসাবে না ভেবে
অতিমানব হিসেবে চিন্তা করে আইনের মাঝে সমাধান না খুজে আইনের বাইরে গিয়ে অতিমানবীয়
সমাধান খুজতে থাকি এবং উভয়পক্ষ বিভিন্ন অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধার কথা কল্পনা করতে
থাকে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এই প্রতিকূল পরিবেশে শ্রমিকদের ন্যূনতম
জীবনমান রক্ষা করে জীবন ধারন সহ একটি প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ সময় ধরে প্রতিকূল পরিবেশে
কিভাবে টিকে থাকবে এ সকল সমস্যার সমাধান আইনে না খোঁজে নিজেরা নিজেদের মন মত
ব্যাখ্যা দিচ্ছি, যেখানে আইনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া
দেওয়া আছে। এমন অবস্থায় যদি একটি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে তবে সেক্ষেত্রে বন্ধ থাকাবস্থায়
প্রতিষ্ঠানের কি করণীয় তা সুস্পষ্ঠ ভাবে আইনে ব্যাখ্যা আছে এবং বন্ধকালীন সময়
প্রতিষ্ঠান ঠিক আইনে যেভাবে বলা আছে সেভাবেই চলবে। বর্তমান প্রেক্ষাপট যেহেতু
মহামারি সেহেতু প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে এবং শ্রমিকগণ লে-অফ থাকবে বাংলাদেশ শ্রম আইন
২০০৬ এর ১২ ধারায়, শ্রমিকগণ ক্ষতিপূরণ পাবে ১৬ ধারায়। এ
অবস্থায় যেমন শ্রমিকদের বেতন ভাতাসহ জীবন ধারণের কথা ভাবতে হবে ঠিক তেমনি অপরদিকে
প্রতিষ্ঠানের পুজিসহ টিকে থাকার কথাও ভাবতে হবে। এই পরিস্থিতিতে শ্রম আইন বলছে
লে-অফ করার জন্য। লে-অফের সময় সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে নির্ধারিত সময় এবং নির্দিষ্ট
অনুপাতে মূল মজুরি ও বাড়িভাড়া পরিশোধের কথা বলা আছে। এখানে অনেকে বলছে যে এ
অবস্থায় অন্যান্য সুবিধাসমূহ পাবে কি না? যেহেতু এটি একটি
বিশেষ ব্যবস্থা সুতরাং এ অবস্থায় ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা সমূহ আইন অনুসারে পাবে
না। লে-অফ কালিন সময়ে শুধুমাত্র দুইটি (মজুরি ও বাড়িভাড়া) বিষয়ের কথা আইনে বলা
হয়েছে যাহা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সুতরাং এখানে অন্যান্য সুবিধা সমূহ এ অবস্থায়
বন্ধ থাকবে৷
আরেকটি বিষয় বলে রাখা দরকার যে অন্যান্য সুযোগ সুবিধা শুধুমাত্র একজন
শ্রমিকের কর্মকালীন সময়ে অধিকারপ্রাপ্ত। লে-অফ থাকাবস্থায় অনেকে মতামত ব্যক্ত
করেছেন যে শ্রমিকদের সুযোগ সুবিধা কমানো হচ্ছে। এটি একটি ভ্রান্ত ধারনা কারণ
যেহেতু আইনে লে-অফ থাকা কালীন সময়ের শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ পরিশোধের সুস্পষ্ট
ব্যাখ্যা আছে সেখানে ভিন্ন রকম কথা বলার কোনো সুযোগ নাই। এক্ষেত্রে যদি কোনো
প্রতিষ্ঠান লে-অফ থাকা কালীন অবস্থায় উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের কম প্রদান করে
সেক্ষেত্রে এমন অভিযোগ যুক্তিযুক্ত।
যেখানে ঈদের সময় তিন দিনের জায়গায় পাঁচ দিন ছুটি দিলে বাকি ২ দিন কাজ করতে
হয়, সেখানে এমন
অবস্থায় মাসের পর মাস বসে থেকে মালিক পক্ষ সকল সুযোগ সুবিধা দিবে এটি কল্পনা করা
বা ভাবাও কতটুকু যুক্তিযুক্ত সেটাও চিন্তার বিষয়। যেহেতু বর্তমানে একটি অস্বাভাবিক
অবস্থা বিরাজমান সেহেতু শ্রমিকরাও যেন প্রতিষ্ঠান দ্বারা শোষিত না হয় বা তাদের
ন্যায্য অধিকার যেন প্রতিষ্ঠিত হয় সেটা খেয়াল রেখে অপরদিকে প্রতিষ্ঠানও যেন দীর্ঘ
সময় পুঁজি নিয়ে টিকে থাকতে পারে সেটাও ভাবতে হবে। তাই আমরা উভয় পক্ষ নেতিবাচক
মন্তব্য করা থেকে সংযত থেকে সকল সুযোগ সুবিধা আইন অনুসারে ন্যূনতম ভোগ করে এই কঠিন
সময় পার করাই এখন আমাদের শপথ হওয়া উচিত।
মহামারী কালীন সময় কারখানা বন্ধ করা যাবে এবং শ্রমিকগণ লে-অফ নীতি অনুসরণে
পরিশোধ পাবেন।
একটি কারখানায় শ্রম আইন অনুসারে তিন ধরণের কর্মী থাকে।
১. ব্যবস্থাপনামূলক কাজে নিয়োজিত কর্মী
২. তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মী
৩. শ্রমিক
তাই একটি কারখানা বন্ধ করতে হলে মালিককে উক্ত তিন ধরণের কর্মীর ব্যাপারে
সিদ্ধান্ত নিতে হয়।
যেহেতু শ্রম আইনে লে-অফ নীতি অনুসারে শ্রমিকদের ক্ষতিপূরনের কথা বলা আছে, কিন্তু লে-অফ কালীন সময়ে ব্যবস্থাপনামূলক
কাজে নিয়োজিত কর্মী ও তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগণের পরিশোধ কি হবে উক্ত
বিষয়টি শ্রম আইন বা অন্য কোন আইনে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোন নির্দেশনা নেই।
সাধারণ মালিক পক্ষ প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নের্তৃত্বর মনোবল ধরে রাখতে ব্যবস্থাপনামূলক
ও তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগনকে লে- অফ না করে পুর্ন পরিশোধ দিয়ে কর্মরত
রাখেন। তথাপি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সংকট মোকাবিলায় এধরণের কর্মী লে-অফ করতে হলে
নিন্মলিখিত বিষয় বিবেচনায় আসবে।
আমরা জানি, ব্যবস্থাপনামূলক কাজে ও তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগনের
চাকুরির যাবতীয় শর্তাবলি কর্মীদের সাথে সম্পাদিত চুক্তি (নিয়োগ পত্র) অনুসারে
নিয়ন্ত্রিত হয়। তাদেরকে প্রদত্ত নিয়োগ পত্রে যদি এ ধরনের সংকট কালীন সময়ে কোম্পানী
বন্ধ থাকে এবং শ্রমিকগন লে-অফ থাকে, তবে উক্ত সময়
সংশ্লিষ্ট কর্মীর জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম পরিশোধ কি হবে তা উল্লেখ থাকে তবে সে
অনুসারে পরিশোধ করতে হবে, নিয়োগ পত্রে উক্ত বিষয় উল্লেখ
না থাকে তবে কোম্পানীর শ্রমিকগনের লে-অফ কালীন সময় ব্যবস্থাপনামূলক কাজে ও
তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগণের পরিশোধ কি ভাবে হবে এ ধরণের নীতি থাকে তবে
সে নীতি অনুসারে পরিশোধ পাবেন।আর যদি নিয়োগ পত্রে উল্লেখ বা কোম্পানীর এই
সংক্রান্ত নীতি না থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের
লে-অফ কালীন সময়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধকালীন অবস্থায় তাদের কর্মহীন সময়ে প্রতিষ্ঠান কি
পরিমান ক্ষতিপূরণ প্রদান করবে তাহা কর্মীদের সাথে চুক্তির মাধ্যমে নির্ধারণ করতে
হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যবস্থাপনামূলক ও
তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগনের যতক্ষন পর্যন্ত চাকুরীর পরিসমাপ্তি ঘটবে
না ততক্ষণ পর্যন্ত তারা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মরত এবং সব অবস্থায় পরিশোধ পাবে।
অবস্থা বিবেচনায় পরিশোধের পরিমান কমবেশি হতে পারে।
এধরনের নীতি নির্ধারনে মালিক পক্ষকে অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে যে, প্রত্যেক মানুষের পরিবার আছে এবং
জীবিকা নির্বাহের জন্য সংকট কালীন সময় বেতন না দিলেও তাদের পরিবারের ভরণ পোষণের
জন্য ন্যূনতম আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যাতে তারা
পরিবার পরিজন নিয়ে সসম্মানে বেঁচে থাকতে পারে।
তাই ব্যবস্থাপনামূলক ও তত্ত্বাবধানমূলক কাজে নিয়োজিত কর্মীগনের বিষয়ে আইনে
ক্ষতিপূরন সুনির্দিষ্ট করে কিছু বলা না থাকলেও সংশ্লিষ্ট স্থায়ীভাবে নিযুক্ত
সবাইকে ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করতে হবে, আর্থিক ক্ষতিপূরণ পরিশোধ করা না হলে বিষয়টি হবে
অযৌক্তিক ও প্রচলিত রীতিনীতি বিরোধী এবং ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ আদালতে আশ্রয় গ্রহণ করলে
তার প্রতিকার পাবেন।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এ শ্রমিকদের লে-অফের যে নীতির কথা বলা হয়েছে এখন তার কিছু বিষয়
নিয়ে আলোচনা করব।
লে-অফ ক্ষতিপুরন কারা পাবে?
বদলী ও সাময়িক শ্রমিক নহেন এরুপ কোন শ্রমিক যার নাম প্রতিষ্ঠানের মাষ্টার
রোলে অন্তর্ভুক্ত আছে এবং যিনি মালিকের অধীন অন্তঃত এক বৎসর চাকুরিতে কর্মরত ছিলেন
তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন এবং যার চাকুরিকাল এক বৎসরের নিচে তিনি কোন ক্ষতিপূরণ পাবেন
না।
ক্ষতিপূরনের পরিমান কি?
ক্ষতিপূরনের পরিমান হবে কোন পন্জিকা বৎসরে অবিচ্ছিন্নভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে
প্রথম ৪৫ দিন বেসিকের অর্ধেক এবং আবাসিক ভাতা সম্পূর্ণের সমান। ৪৫ দিনের পরবর্তী
১৫ বা ততোধিক দিনের জন্য বেসিকের এক চতুর্থাংশ এবং আবাসিক ভাতা সম্পূর্ণের সমান।
এখানে উল্লেখ্য যে, লে-অফের মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটির দিনের জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রমিক কোন
ক্ষতিপূরণ পাবেন না।সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত অন্য সকল দিনের জন্য লে-অফের
ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবেন এবং ঘোষিত দিনগুলি শুধুমাএ লে-অফের দিন হিসেবে পরিগনিত হবে,
সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত অন্য কোন ছুটির দিন এমন কি ইতিপূর্বে
ঘোষিত উৎসব ছুটি এর মধ্যে পড়লেও এক্ষেত্রে বিবেচনায় আসবে না।
লে-অফ কালীন সময় যে পরিশোধ করা হয় তা মজুরি না ক্ষতিপূরণ ?
লে-অফ কালীন সময়ে যে পরিশোধ করা হয় তা কোন মজুরি নয়, এটি হচ্ছে ক্ষতিপূরন । অনেকে মনে
করেন এ সময়, মজুরি পরিশোধের সকল উপাদান পরিশোধ করতে হবে।
এখানে যে বিষয়টি লক্ষণীয়, সেটি হচ্ছে লে-অফ কালীন সময়ে
মজুরি পরিশোধ করা হয় না এবং এটি একধরণের ক্ষতিপূরণ। একজন শ্রমিকের কর্মহীন অবস্থায়
জীবন ধারণের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান। আইনে নির্ধারিত অনুপাতে বেসিক মজুরি ও আবাসিক
ভাতা এই এ দুটির সমন্বয়ে উক্ত ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয়। তাই এ দুটি ছাড়া অন্য
উপাদান দাবি করা আইনসঙ্গত নয়।
অনেকে প্রশ্ন করেন, লে-অফ কালীন সময়ের মধ্যে উৎসব ছুটি পড়লে কারখানায় ঘোষিত উৎসব ছুটি এবং
উৎসব বোনাস পাবে কিনা?
লে-অফ চলাকালীন সময় কিছু কিছু অধিকার বাতিল এবং কিছু কিছু অধিকার স্থগিত
হয়ে থাকবে। যে সব অধিকার ভোগ সময়ের সাথে সংশ্লিষ্ট সে গুলো বাতিল হয়ে যাবে। যেমন
লে-অফ কালীন সময়ের মধ্যে উৎসব ছুটি পড়লে তা ভোগের অধিকার বাতিল হয়ে যাবে।
পক্ষান্তরে যে সব অধিকার অর্জিত কিন্তু ভোগ করা কোন নির্দিষ্ট সময়ের সাথে
সংশ্লিষ্ট নয় সে গুলো বাতিল না হয়ে স্থগিত হয়ে থাকবে, যেমনঃ অর্জিত ছুটি , মার্তৃত্ব কল্যাণ সুবিধার পরিশোধ, বৎসরে দুটি
উৎসব বোনাস ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠান যখন স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে তখন অথবা
সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের চাকুরী পরিসমাপ্তির সময় বকেয়া হিসেবে পরিশোধ করতে হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, লে-অফ কালীন সময়ে ঈদ পড়লে ঈদের বোনাস প্রযোজ্য হবে না, কিন্তু যেহেতু শ্রম আইন ও বিধিমালায় বলা আছে কোন শ্রমিকের চাকুরিকাল ১
বৎসর পূর্ণ হলে উক্ত শ্রমিক বৎসরে দুইটি উৎসব ভাতা পাবেন, সেহেতু লে-অফ কালীন সময়ে উৎসব ভাতা পরিশোধ না করা হলেও লে-অফ
প্রত্যাহার করার পর অপরিশোধিত উৎসব বোনাস পরিশোধ করতে হবে। অর্থাৎ বছরে দুটি উৎসব
বোনাস পরিশোধ করতে হবে।
একটি প্রতিষ্ঠানে কি সবাইকে এক সাথে লে অফ করতে হবে?
একটি প্রতিষ্ঠানে সবাইকে বা কোন বিভাগ বা কোন বিভাগের আংশিক বা নির্ধারিত
সংখ্যক যারা প্রয়োজন অতিরিক্ত শ্রমিক তাদেরকে লে- অফ করা যায়।
লে -অফ কালীন কি লে অফকৃত শ্রমিক দিয়ে কাজ কারানো যাবে?
লে- অফ কালিন সময় যদি প্রতিষ্ঠানে কোন প্রয়োজন হয় তবে লে- অফকৃত শ্রমিক
দিয়ে কাজ করানো যাবে। এধরণের কাজে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক যেদিন কাজ করবেন সেদিনের
পুর্নহাজিরা ও মজুরী পাবেন।
ঘোষিত লে- অফ নিদ্দিষ্ট সময়ের পুর্বে প্রত্যাহার করে কাজ শুরু করা যাবে
কিনা?
লে- অফ যে সমস্যার কারনে ঘোষিত হয়েছে সে সমস্যা যদি লে- অফ ঘোষিত সময়ের
পূর্বে সমাধান হয়ে যায় তবে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে ঘোষিত সময়ের পূর্বে
লে- অফ প্রত্যাহার এবং প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে পারবেন।
লে- অফকৃত শ্রমিকগন কি কারখানাই প্রত্যেক দিন হাজিরা দিতে হবে?
ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ইচ্ছা অনুসারে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের দিনে একবার
হাজিরা দিতে হতে পারে অথবা ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে উক্ত শ্রমিকদের
হাজিরা হতে অব্যাহতিও প্রদান করতে পারেন।
লে- অফ সময় কতদিন বৃদ্ধি করা যাবে?
যতদিন প্রয়োজন ততদিন ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ লে- অফ সময় বৃদ্ধি করতে
পারবেন।
লে- অফ শুরু হওয়ার পুর্বে বা লে- অফের সময় বা লে- অফ শেষ হওয়ার পর
প্রতিষ্ঠানে কি শ্রমিক ছাটাই করা যাবে?
আইন নির্ধারিত সকল সুবিধা নিশ্চিত করে ছাটাই করা যাবে।
লে-অফ এবং চাকুরী ছাটাই কি?
অনেকে মনে করেন শুধুমাএ লে-অফের ক্ষতিপূরণ দিয়ে একজন শ্রমিকের চাকুরি
পরিসমাপ্তি করা যায় এটি একটা ভুল ধারণা, কারন লে- অফ কোন চাকুরী পরিসমাপ্তির ধরন নয়। লে-অফ বলতে
বুঝায় একজন শ্রমিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত আছেন কিন্তু আইনে নির্ধারিত কোন
অস্বাভাবিক অবস্থার জন্য প্রতিষ্ঠানে কাজ বন্ধ আছে এবং উক্ত কাজ বন্ধ কালিন সময়
সংশ্লিষ্ট শ্রমিককে আইন নির্ধারিত হারে ক্ষতিপূরণ প্রদান করে চাকুরীতে বহাল রাখা।
লে-অফ কালীন বা লে-অফ পরবর্তীতে কোন শ্রমিককে ছাটাই করা হয়, তবে উক্ত শ্রমিককে অবশ্যই ছাটাইয়ের জন্য আইনে উল্লেখিত ক্ষতিপূরণ এবং
নোটিশের পরিবর্তে পরিশোধ, অর্জিত ছুটির টাকা সহ অন্যান্য
বকেয়া পাওনা পরিশোধ করে ছাটাই করতে হবে।
বেতন বা মজুরি পরিশোধের দায় এবং মজুরি পরিশোধের জন্য বিশেষ সুবিধায় প্রাপ্য
লোনঃ
মালিকপক্ষ সবসময় কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিকগণের বেতন ও মজুরী পরিশোধের জন্য দায়ী
থাকে, উক্ত মজুরী পরিশোধের উৎস বিশেষ সুবিধায় প্রদত্ত লোন
গ্রহণের মাধ্যমে হতে পারে কিংবা কোম্পানীর নিজস্ব ফান্ড হতে পারে। মজুরি প্রদানের
জন্য ফান্ডের ব্যবস্থা করা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ব্যাপার। মজুরি
পরিশোধের অর্থের উৎসের সাথে মজুরি পরিশোধের দায়ের কোন সম্পর্ক নেই।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এবং প্রযোজ্য অন্যান্য আইন অনুসারে এটি একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা,
অত্র আলোচনায় লে-অফের সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলী সংক্ষেপে তুলে
ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। অত্র বিষয়ে কারো কোন প্রশ্ন বা যৌক্তিক সমালোচনা আমরা সব
সময় স্বাগত জানায় ।
`
Emrul Hasan & Abm Mostafa Siddique
0 Comments