শ্রমিকের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রসঙ্গে By ফজলুল কবির মিন্টু


জন্মালে মরতে হবে। এটা চিরন্তন সত্য। তারপরও কিছু মৃত্যু আছে যা মেনে নেয়া কষ্টকর। নিহত ব্যক্তি যদি হয় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি, তাহলে সমগ্র পরিবারে নেমে আসে অমানিসার ঘোর অন্ধকার। সাড়ে ছয় কোটি শ্রমিকের বাংলাদেশে কত শ্রমিক পরিবার যে, প্রতিনিয়ত এমন নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে তার সঠিক পরিসংখ্যান তুলে ধরার মত সংস্থা আমাদের দেশে এখনও গড়ে ওঠেনি। পরিসংখ্যান যাই হোক বাস্তবতা হচ্ছে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পথে বসেছে হাজার হাজার শ্রমিক পরিবার। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গিয়ে শ্রমিকের জীবনের চাকা যদি থেমে যায় তখন রাষ্ট্র, সমাজ বা নিয়োগকর্তা কি বিপন্ন শ্রমিক পরিবারের পাশে দাঁড়ায়? দাঁড়ালেও কতটুকু?

আমাদের দেশে মোট শ্রমিকের ৮৭% অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। যাদের চাকরির নিশ্চয়তা বা সুনির্দিষ্ট নিয়োগ কর্তা নাই। এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকের সুরক্ষায় শ্রম আইনে কোন কিছুর উল্লেখ নেই। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কোন শ্রমিক মারা গেলে, আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করলে কিংবা কঠিন কোন মরণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড থেকে হতভাগ্য শ্রমিক বা শ্রমিকের পরিবার দুই লক্ষ টাকা পর্যন্ত সাহায্য পায়। এই তথ্যটুকু শ্রমিকরা সঠিকভাবে না জানার কারণে বেশীর ভাগ শ্রমিক এই সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে এই ব্যাপারে খুব বেশী ভূমিকা রাখতে দেখা যাচ্ছেনা।

প্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকেরা মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ কি পায় তা জানার জন্য প্রথমে মৃত্যুর ধরন বুঝতে হবে। যদি স্বাভাবিক মৃত্যু হয় এবং শ্রমিকের চাকরির বয়স যদি দুই বছর পূর্ণ হয়, শ্রম আইনের ১৯ ধারা মতে কর্মস্থলে কর্মরত অবস্থায় অথবা কর্মস্থলে আহত হয়ে পরবর্তীতে মারা গেলে প্রতি বছর চাকরির জন্য ৪৫ দিন এবং কর্মস্থলের বাহিরে অর্থাৎ শ্রমিকের বাসায় বা অন্য কোন জায়গায় মারা গেলে প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি প্রাপ্য হয়। এর বাইরে শ্রমিক স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করলে যা প্রাপ্য হতো তাও শ্রমিকের উপরিউক্ত পাওনার সাথে যুক্ত হবে। শ্রম আইনের ১৫১ ধারা মোতাবেক চাকরিরত অবস্থায় আহত হয়ে কোন শ্রমিক মৃত্যু বরণ করলে তার পরিবার ২ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হয়। কোন শ্রমিক আহত হওয়ার পর পঙ্গু হলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকা প্রাপ্য হয়। আবার কোন শ্রমিক আহত হয়ে হাত, পা, চোখ ইত্যাদি অঙ্গহানির কারণে আংশিক কর্ম ক্ষমতা হারালে ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার আনুপাতিক হারে তপশীল-১ এ নির্দেশনা অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হয়।

শ্রম আইনের ৮৬ ধারা মতে যদি কোন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক কর্মক্ষেত্রের কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে বলে বুঝতে পারার পর মালিককে তা লিখিতভাবে অবহিত করেন, তাহলে মালিক তৎসম্পর্কে ৩ দিনের মধ্যে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য। মালিক যদি কোন ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয় এবং উক্ত বিপজ্জনক ভবন বা যন্ত্রের কারনে যদি শ্রমিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু বরণ করে শ্রম আইনের ১৫১ ধারায় উল্লেখিত ক্ষতিপূরণের দ্বিগুন হারে ক্ষতিপূরণ প্রাপ্য হবে। অর্থাৎ মৃত্যু হলে ৪ লক্ষ, পঙ্গু হয়ে গেলে ৫ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ শ্রমিক বা তার পরিবার পাবে। শ্রম আইনের এই ধারাটি নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। কেননা শুধুমাত্র ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বাড়িয়ে মালিকের দায় মুক্ত হওয়ার অবকাশ নাই। কর্মক্ষেত্রের কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে তা মালিক অবহিত হওয়ার পরও যদি মালিকের অবহেলার কারনে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে তার জন্য মালিকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়েরের সুযোগ থাকা উচিৎ বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করে। কর্মক্ষেত্রে কোন ভবন বা যন্ত্রপাতি বিপজ্জনক অবস্থায় আছে, তা মালিকের নজরে আনার সাথে সাথে ঐ স্থানে কাজ বন্ধ করে দিতে হবে। মালিক যদি তা না করে তাহলে শ্রমিকও কাজ করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারবে, এমন অধিকার তাকে দিতে হবে।

কোন শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে আহত হয়ে পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করলে সেক্ষেত্রে ১৯ ধারায় নাকি ১৫১ ধারায় ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে তা নিয়েও জটিলতা বিদ্যমান তাই এই ব্যাপারে শ্রম বিধিমালায় বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে।

২০০৬ সনে যখন শ্রম আইন প্রণয়ন হয় তখন কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিকের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ১ লক্ষ টাকা এবং পঙ্গু হয়ে শতভাগ কর্মে অক্ষম হলে তার জন্য ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকার কথা উল্লেখ ছিল। ২০১৩ সনে রানা প্লাজা দূর্ঘটনায় ব্যাপক শ্রমিক নিহত হওয়ার পর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ উপলব্ধি করে যে, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় শ্রমিককে প্রদেয় ক্ষতিপূরণ অপ্রতুল। যদিও জীবনের মূল্য কোনভাবেই অর্থের বিনিময়ে পূরণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণ এমন হওয়া উচিৎ যাতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তাদের পারিবারিক সংকট এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়। এই বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আইএলও কনভেনশন ১২১ এর সাথে সংগতি রেখে Loss Of Year Earnings, Sufferings and pain এর উপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণ প্রদানের দাবি জানায় বিভিন্ন মহল। Loss Of Year Earnings, Sufferings and pain এর উপর ভিত্তি করে ক্ষতিপূরণের অর্থ হলো নিহত শ্রমিক বেঁচে থাকলে বাকী জীবনে কি পরিমাণ টাকা আয় করতেন অথবা দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করা শ্রমিকের দুঃখ যন্ত্রণা ভোগসহ অন্যান্য ক্ষতি হিসাব করে এবং তা বিচার বিশ্লেষণ পূর্বক ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণ করা। রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক বা শ্রমিক পরিবার সমূহকে ক্ষতিপূরণ প্রদানের জন্য গঠিত কমিটি তা অনুসরণ করার চেষ্টা করে। পরবর্তীতে তার ধারাবাহিকতায় কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ ১০ লক্ষ টাকা করার দাবি জানিয়ে আসছে বিভিন্ন মহল। ২০১৮ সালে শ্রম আইনের সংশোধনীর সময় সবার ধারণা ছিল এই বিষয়টি আমলে নেয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে শ্রম আইনের সংশোধনীতে তার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

শ্রম আইনের ৯৯ ধারা অনুযায়ী কোন প্রতিষ্ঠানে ১০০ জন স্থায়ীশ্রমিক কর্মরত থাকলে গ্রুপ বীমা বাধ্যতামূলক। শ্রম আইনের এই ধারাটির কার্যকর প্রতিফলন কোথাও দেখা যায় না। আমার জানা মতে শ্রমিকদের গ্রুপবীমার ব্যাপারে কোন বীমা কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে এই দেশে এমন প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার ২০১৮ সনের সংশোধনীতে শ্রম আইনের ৯৯(৩) ধারায় শত ভাগ রপ্তানিমুখী শিল্প সেক্টর হিসাবে গার্মেন্টস সেক্টরকে গ্রুপ বীমা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। বর্তমানে বিজিএমইএ মৃত শ্রমিকদের ২ লক্ষ টাকা বীমার টাকা হিসাবে মৃত শ্রমিকদের পরিবারকে দিয়ে থাকে। যা রপ্তানি আয়ের বিপরীতে গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলের টাকা এবং এটা মূলত শ্রমিকের কল্যাণের জন্য গঠিত তহবিল। শ্রমিকের কল্যাণের জন্য গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলের টাকা থেকে মৃত শ্রমিকের বীমার টাকা পরিশোধ শুভঙ্করের ফাঁকি ছাড়া আর কি?

শ্রম আইনের ২৬৪ ধারায় শ্রমিকের ভবিষ্যৎ তহবিল গঠনের কথা উল্লেখ থাকলেও কোন প্রতিষ্ঠানের ৭৫% শ্রমিক লিখিত আবেদন না করলে মালিক ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করতে বাধ্য নয় বিধায় শ্রম আইনের এই ধারাটিও কার্যকারিতা হারিয়েছে। ফলে একজন শ্রমিক অবসর গ্রহণ করলে, কর্মে অক্ষম হলে কিংবা মৃত্যুবরণ করলে শ্রম আইন মোতাবেক যে সুবিধাগুলো সে প্রাপ্য হবে সেগুলোও কার্যকর নাই।

সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ এর ২৩ অনুচ্ছেদে শ্রমজীবী মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা উল্লেখ আছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারের কথা যুক্ত করা হয়েছে। সুতরাং সামাজিক নিরাপত্তা প্রত্যেক নাগরিকের মানবিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। আজ প্রশ্ন জাগে আমাদের দেশে শ্রমিক শ্রেণির সামাজিক নিরাপত্তা কি আদৌ আছে?

শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে মালিক-শ্রমিক-রাষ্ট্র ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগ থাকতে হবে। রাষ্ট্র আইন প্রণয়নের পাশাপাশি আইনগুলো যেন বাস্তব সম্মত এবং কার্যকর হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। মালিককে বুঝতে হবে শ্রমিকের মানসিক প্রশান্তি ছাড়া দক্ষ শ্রম শক্তি গড়ে উঠবে না আর দক্ষ শ্রম শক্তি ব্যতিরেকে শিল্পের বিকাশ অসম্ভব। অন্য দিকে সামাজিক নিরাপত্তাসহ শ্রমিকের ন্যায়সংগত সকল অধিকার আদায়ে লবি, এডভোকেসি, ক্যাম্পেইন এবং সামাজিক সংলাপের পাশাপাশি আন্দোলন অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি।

লেখক :
ফজলুল কবির মিন্টু

ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক, টিইউসি, চট্টগ্রাম

Post a Comment

0 Comments