ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনের
এক বস্তিতে টম ক্যান্টি নামে একটি ছেলের জন্ম হলো। তার বাপমায়ের মুখে হাসি নেই। কারণ
তারা খুব দরিদ্র। তাদের চিন্তা বাড়ল এই ভেবে যে, আরও একটা মুখে খাবার জোটানোর ব্যবস্থা
করতে হবে। আর ঠিক একই সময়ে একই দিনে ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড টিউডরের ঘরে একটি ছেলের
জন্ম হলো। এই ছেলের জন্মে রাজ্যময় খুশির ঢেউ বইল এবং নানা আনন্দ-উৎসবের আয়োজন হলো।
রাজকুমার বিজ্ঞ পন্ডিতের
কাছে বিদ্যাশিক্ষা নিতে লাগলেন আর বস্তির ছেলে ক্যান্টি বস্তির লোকের কাছ থেকে ভিক্ষা
করার শিক্ষা নিল। তবে সে এক ধর্মযাজক ফাদার এন্ড্রুর কাছে কিছু কিছু লেখাপড়া লিখছিল।
বিশেষ করে ল্যাটিন শিখছিল। টম ছিল কল্পনা বিলাসী, সে সবসময় রাজা আর রাজকুমারদের স্বপ্নে
বিভোর হয়ে থাকত। সে যতই রাজকীয় কল্পনাতে ডুবে থাকত ততই সবার উপহাসের পাত্র হতো। তার
সমবয়সী ছেলেমেয়েদের কাছে সে রাজকুমার নামেই পরিচিত হতে চাইত। সেজন্য তাদের নিয়ে রাজকীয়
সভার অনুসরণ করে নিজে রাজা হতো এবং অন্যদের উপাধি বন্টন করুনত। ছেলেমেয়েরাও তার এই
পাগলামি খেলা উপভোগ করুনত এবং আনন্দ পেত। সে মনে মনে ভাবত : আহা সত্যিকার রাজকুমারের
যদি দেখা পেতাম!
একদিন সে হাঁটতে হাঁটতে
অনেক দূরে এক অচেনা জায়গায় এসে গেল। সেখানে বিরাট বিরাট অট্টালিকা দেখল। এই অট্টালিকাগুলোর
মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর ওয়েস্টমিনিস্টারস প্যালেসে সে এলো। এসে মনে মনে ভাবল, এত বড় অট্টালিকা
নিশ্চয়ই কোনো রাজপ্রাসাদ হবে। এমন সময় গেটের ফাঁক দিয়ে সে তার বয়সী এক বালককে সুন্দর
পোশাক পরা অবস্থায় দেখতে পেল। তখনই সে মনে মনে ভাবল, এ নিশ্চয়ই সত্যিকারে রাজকুমার
হবে। ঠিক এমনি সময় পিছন থেকে তার ঘাড়ে এক পদাঘাত এল। বস্ত্তত এই পদাঘাতটি ছিল দারোয়ানের।
সে বলল, এই ভিখারির বাচ্ছা, সরে পড়। কোন সাহসে এখানে এসেছিস? অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে গেটের
ভিতরের রাজকুমারের নজরে সমস্ত ব্যাপারটা পড়ে গেল। রাজকুমার চিৎকার করে বলে উঠলেন দারোয়ান,
আমার বাবার গরিব প্রজার সঙ্গে এমন জঘন্য ব্যবহার করতে তুমি কী করে সাহস পেলে? এখনই
দরজা খুলে এই বালককে আমার কাছে নিয়ে এসো।
ভিতরে ঢোকার পর রাজকুমার
বললেন, তুমি পরিশ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত এবং তোমার প্রতি খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে! তুমি
আমার সঙ্গে এসো।
কথাটা যেন টমের বিশ্বাস
হতে চায় না। সে বলল, ঠিক বলেছেন তো স্যার, আপনার সঙ্গে আসব?
রাজকুমার অভয় দিয়ে
বললেন, হ্যাঁ তোমার কোনো ক্ষতি হবে না। তুমি আমার সঙ্গে এসো।
ক্যান্ট রাজকুমারের
সাথে ভিতরে গেল। দুজনাতে অনেক গল্প হলো। রাজকুমার টমকে রাজপ্রাসাদ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখালেন।
টমের কাছে সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল। সে রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করুনল, আপনাকে
কী সবসময় এই সুন্দর পোশাক পরে থাকতে হয়?
(৭)
নিশ্চয়ই।
আপনার জীবন কি সুখের!
আর রাজকুমার শুনল
টমের বস্তি জীবনের কথা।
সে বলল, যেকোনো সময়
নদীতে সাঁতার কাটা যায়, কাদা নিয়ে খেলা করা যায়, একে অন্যের দিকে কাদা ছুড়ে মেরে মজা
করা যায়।
তখন রাজকুমার বললেন,
তোমার জীবনও নিশ্চয়ই আনন্দে আর খুশিতে ভরা। আহা আমি যদি তোমার পোশাক পরে কাদায় খেলা
করতে পারতাম, তাহলে কী আনন্দটাই না পেতাম!
টম বলল, আর আমি যদি
আপনার পোশাক পরতে পারতাম তাহলে কী আনন্দই না পেতাম!
রাজকুমার বললেন, তুমি
যদি চাও তাহলে আমরা পোশাক বদল করতে পারি। তারপরে তারা উভয়ে পোশাক বদল করে নিল।
তারা উভয়ে একে অপরের
দিকে আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল, কারণ তাদের চেহারা ও পোশাকে কে যে ভিখারির ছেলে আর কে
যে রাজকুমার তা কেউ চিনে বের করতে পারবে না। কারণ তাদের দুজনার চেহারা দেখতে হুবহু
এক। শুধু পোশাক দ্বারা তাদের ভিন্ন করা যায়। টমের হাতের আঘাত পরীক্ষা করে রাজকুমার
বললেন, উহ্! তোমার নিশ্চয়ই খুব লেগেছিল? টম বলল, না, ও
কিছু নয়। আমি এমনি
আঘাত আর মার খেয়ে অভ্যস্ত। যে দারোয়ান টমকে মেরেছিল তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ভিক্ষুকের
পোশাকে রাজকুমার বাড়ির গেইটের দিকে গেল ও চিৎকার করে বলল, দরজা খোলো। দারোয়ান তার কথামতো
দরজা খুলে দিল।
(৮)
রাজকুমার যেইমাত্র
দরজার বাইরে বেরিয়েছে অমনি দারোয়ান তাকে কষে এক চড় দিয়ে বলল, হে ভিখারির ছেলে, আমাকে
রাজকুমারের হাতে বকা খাওয়ানোর জন্য এটা তোর বখশিশ। ভিখারির পোশাকে রাজকুমার মাটিতে
পড়া অবস্থায় বলল, বদমাইশ, আমি হচ্ছি রাজকুমার এডওয়ার্ড আর রাজকুমারের গায়ে হাত তোলা
মস্ত অপরাধ। তখন দারোয়ান বলল, দূর হ ভিখারি, এখান থেকে। এই সময় রাস্তার লোকজনেরাও তাকে
মারল।
তাদের হাত থেকে অনেক
কষ্টে বের হয়ে রাজকুমার একা একা পথ চলতে লাগল। চলতে চলতে এক সময় সে এক অচেনা পথে চলে
এল। এখানে সে একটা ছোট ছেলেমেয়েদের হোস্টেল দেখল। তখন তার মনে হলো যে, এই হোস্টেল নির্মাণ
করুনছেন তার বাবা। তাই সে সাহস করে হোস্টেলের ভিতর ঢুকে বলল,হে কিশোররা, আমি তোমাদের
সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। তোমরা ভিতরে গিয়ে বসো ও অন্যদের বলো যে, রাজকুমার এডওয়ার্ড
তাদের সঙ্গে আলাপ করতে চায়।
সেখানকার ছেলেমেয়েরা
বেশ মজা পেল। তারা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করুনল, ছেলেটা নিশ্চয়ই পাগল হবে। ঠিক আছে আমরা
সবাই তাকে রাজকুমার মনে করে সম্মান দেখাই। দেখা যাক ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়। তাই সবাই
হাঁটু গেড়ে বসে রাজকুমারকে সম্মান দেখাল। তারপর সবাই তাকে চ্যাংদোলা করে ধরে নিয়ে সামনের
পুকুরে ছুড়ে ফেলল। রাজকুমার আবার সবার হাতে অপমানিত হলো।
পুকুর থেকে উঠে সে
আবার হাঁটতে লাগল। দিন শেষে রাত্রি ঘনিয়ে এল। তখন রাজকুমার ভাবল: আমার কথা কেউ বিশ্বাস
করুনছে না। আমার একমাত্র উপায় হলো টমের বাড়ি খুঁজে বের করা। তাহলে তার পিতা-মাতা আমার
প্রাসাদের দারোয়ানের কাছে গিয়ে বললেই হয়তো আমার এই বিপদ কেটে যাবে।
তারপর সে নিকটস্থ
বস্তি এলাকায় ঘোরাঘুরি করতে লাগল। এমন সময় হটাৎ একটা বলিষ্ঠ হাত তার হাত ধরল, সে চিৎকার
করে উঠল, বাঁচাও বাঁচাও! সেই হাতের অধিকারী তখন বলল, এই বদমাইশ চিৎকার করুনছিস কেন?
এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোর হাড়গুলি সব পিটিয়ে ভাঙব-না হলে আমার নাম জন ক্যান্টিই নয়। রাজকুমার
তখন তার দিকে তাকিয়ে বলল, ইশ কী সৌভাগ্য আমার! তাহলে তুমিই তার বাবা? লোকটা বলল, কী
বলিসরে ছোকরা? আমি তার বাবা নই, আমি তোর বাবা। রাজকুমার বলল, মহাশয় আমার সঙ্গে দয়া
করে তামাশা করবেন না। আমি বড় বিপদে পড়েছি। দয়া করে আমার প্রাসাদের দারোয়ানকে যদি আপনি
বলে দেন যে, আমি আপনার ছেলে নই, আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস। এ-কথা শোনার পর লোকটা
বলল, প্রিন্স অব ওয়েলস,পাগল, তোমাকে বেত দিয়ে পিটিয়ে ঠিক করতে হবে। তাহলেই তোমার পাগলামি
ছুটবে। তারপর টমের বাবা তাকে খুব মারতে লাগল। আর রাজকুমার চিৎকার করতে লাগল, আমাকে
যেতে দাও, আমি তোমার ছেলে নই। আমি রাজকুমার প্রিন্স অব ওয়েলস।
হঠাৎ ভিড়ের মধ্যে
ফাদার এন্ড্রুকে দেখা গেল। তিনি এসে বললেন, থামো ছেলেকে মোরো না, সে অসুস্থ। সে তো
তোমার কোনো ক্ষতি করুনছে না। জন ক্যান্টি তখন রাগের মাথায় ফাদারকে এক ঘা বসিয়ে দিল
ও রাজকুমারকে বাড়ির উপরতলায় পাঠিয়ে দিল। তার কিছুক্ষণ পর সে বাড়ির উপরতলায় এসে রাজকুমারকে
জিজ্ঞাসা করুনল, বল তোর নাম কী? রাজকুমার উত্তর দিল, আমি তো তোমায় আগেই বলেছি যে আমার
নাম এডওয়ার্ড প্রিন্স অব ওয়েলস। টমের মা তখন আফসোস করে বলে উঠল, টম তুমি যে বই নিয়ে
পড়াশুনা করেছ, তাতেই এটা হয়েছে।
(৯)
রাজকুমার বলল, আমি
আপনাকে দুঃখ দেয়ার জন্য দুঃখিত। তবে আমি জীবনে আপনাকে আর কখনো দেখিনি। এ-কথা শুনেই
টমের বাবা বেত দিয়ে রাজকুমারকে খুব মারল। রাজকুমার তার রাজকীয় কায়দায় যতই বড় বড় কথা
বলে তার বাবা ততই তাকে মারে। অবশেষে টমের বাবা ক্লান্ত হয়ে টমকে ছেড়ে দিয়ে গেল।
ক্লান্ত রাজকুমার
খড়ের বিছানায় ঘুমিয়ে পড়ল। টমের মা লক্ষ করুনল যে টম তার হাত মাথার উপর রেখে ঘুমায়নি।
মাথার উপর হাত রেখে ঘুমানোটা টমের অনেক দিনের অভ্যাস। তাই তিনি রাজকুমারকে ঘুম থেকে
জাগিয়ে দিলেন। কিন্তু রাজকুমার মাথায় তার হাত নিয়ে গেল না। এমনিভাবে রাতে তিনি তিনবার
এ-কাজটি করলেন। তবুও তিনি স্থির করতে পারলেন না। টমের মায়ের মনে যে সন্দেহ হয়েছিল তা
তিনি জোর করে তাড়িয়ে দিলেন। তিনি ভাবলেন মাথায় গোলমাল হবার জন্য বোধ হয় তার পুরোনো
অভ্যাসটা বদলে গেছে। এদিকে বেশ গভীর রাতে খবর আসল যে ফাদার এন্ড্রুকে টমের বাবা যে
আঘাত করেছিল তার ফলে তিনি মরতে বসেছেন। টমের বাবা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ পালানোর
কথা স্থির করে ফেললেন। তিনি তাড়াতাড়ি তার স্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন: আমি আর টম এখনই চলে
যাচ্ছি। তুমি এসে লন্ডন ব্রিজের কাছে আমাদের সঙ্গে মিলিত হবে। তারপর রাজকুমারকে নিয়ে
জন ক্যান্টি পথে বেরিয়ে দেখতে পেল এক বিরাট উৎসব মিছিল। পথের উৎসবরত লোকেরা তাকে পান
করার জন্য পানীয় দিল। জন ক্যান্টি রাজকুমারকে ছেড়ে যেইমাত্র হাত উপরে তুলল এই
সুযোগে রাজকুমার ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। তারপর রাজকুমার খোঁজ নিয়ে জানতে পারল রাজকুমারের
অভিষেক উপলক্ষে এই উৎসব হয়েছে। তখন সে ভাবতে লাগল: টম ক্যান্টি কি তাকে ফাঁকি দিল?
কিন্তু মনে মনে সে বলল: যেভাবেই হউক আমি তার সব পরিকল্পনা নস্যাৎ করুনব।
এদিকে রাজপ্রাসাদে
টম ক্যান্টির অবস্থাও বড়ই করুনুণ। সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলছে
বাহ্। আমাকে সত্যি একজন রাজকুমারের মতো দেখা যাচ্ছে। আহ! আমার বস্তির সবাই যদি আমাকে
অন্তত একবার এই পোশাকে দেখতে পেত! কিন্তু যতই সময় অতিবাহিত হতে লাগল সে ভীত হয়ে পড়তে
লাগল। হঠাৎ করে একটা দরজা খুলে একটা মেয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করুনল: রাজকুমার
আপনার কি কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে? কিন্তু রাজকুমাররূপী টম ক্যান্টি তখন বিড়বিড় করে
বলে যাচেছ, আমি হারিয়ে গেছি-আমি হারিয়ে গেছি। এরা এবার নিশ্চয়ই আমাকে হত্যা করুনবে।
তারপর সে সেই মেয়েটির কাছেই হাটু গেড়ে বসে বলতে লাগল, আমাকে দয়া করুনো, আমি রাজকুমার
নই আমি টম ক্যান্টি। আমার ছেড়া কাপড়চোপড় আমাকে ফিরিয়ে দাও এবং আমায় বাড়ি যেতে দাও।
কিন্তু মেয়েটি কোনো কথা না বলে দৌড়ে পালিয়ে গেল। তারপর এখান থেকে সেখানে এমনিভাবে প্রচার
হয়ে গেল যে রাজকুমার পাগল হয়ে গেছে। সে অপ্রকৃতিস্থ এবং রাজা নিজে একটা ফরমান জারি
পরে সবাইকে সাবধান করে দিলেন যে রাজকুমারের অসুখের কথা যেন রাজপ্রাসাদের বাইরে না যায়।
একদিন টমকে রাজার
কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে রাজাকে দেখে টম ক্যান্টি বলে উঠল, আপনিই হলেন এখানকার
রাজা। এই কথা শুনে রাজা বললেন, আমি যে গুজব শুনেছিলাম তা দেখছি সত্যি। রাজা আদর করে
তাকে ডাকলেন। কিন্তু টম বলে উঠল, মহাশয়, আপনি আমার বাবা নন এবং আমিও রাজকুমার নই। আমি
আপনার অধীন একজন গরিব প্রজা। কোনো এক দুর্ঘটনার মাধ্যমে আমি এখানে এসে পড়েছি। আমি আপনার
কোনো ক্ষতি করিনি। আমাকে হত্যা করবেন না।
(১০)
রাজা ভাবলেন, বোধ
হয় সে তার নিজের পরিচয় ভুলে গেছে। তাই পরীক্ষা করার জন্য ল্যাটিন ভাষায় প্রশ্ন করলেন।
টম ঠিক ঠিক উত্তরই দিল। তখন রাজা মনে মনে ভাবলেন যে বেশি পড়াশুনা করার ধরুন তার এই
অবস্থা হয়েছে। তাকে খেলাধুলায় ব্যস্ত রাখতে হবে। সে হলো আমার একমাত্র উত্তরাধিকারী।
আর কালই তার অভিষেক করতে হবে। রাজা যাকে কথাগুলো বলছিলেন তিনি বলে উঠলেন যে হুজুর আপনি
কি ভুলে গেছেন নরফোকের ডিউক এখনো আপনার রাজনৈতিক বন্দি, তাকে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে
হত্যা করার আদেশ দিয়েছেন। রাজা বললেন, সে আদেশ ঠিক থাকবে। ঠিক আছে হুজুর, বলে লোকটা
বিদায় নিল।
সেদিন রাজকুমারের
ঘরে বসে টম একা একা বিরক্ত হয়ে ওঠল নিজের ওপর। সে বলল, উহ্! এটা অসহ্য, রাজার আদেশে
এই লোকটাকে হত্যা করা হবে। আহা! এই সময় যদি সত্যিকারের রাজকুমার ফিরে আসত।
সেদিন বিকালে লর্ড
হাটফোর্ড রাজকুমারের সঙ্গে দেখা করে বলল, তুমি যেই হও, তুমি যে রাজকুমার নও এ-কথা অস্বীকার
করুনবে না। টমও ভাবল, ঠিক আছে তারা যেভাবে বলে সেভাবে চলে দেখি। এরপর থেকে টম রাজকুমারের
যাবতীয় কাজ করার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু সে পদে পদে ভুল করতে লাগল। যেমন ভালো তোয়ালে
নষ্ট হবে মনে করে হাত মুছতে ভয় পেতে লাগল। গোলাপজল দেয়া হাত ধোয়ার পানি সে পান করে
ফেলল। ফলমূল বাদাম সব পকেটে পুরে ফেলতে লাগল। সেদিন বিকেলে অসুস্থ রাজার অবস্থা আরও
অবনতি হলো।
রাজার সঙ্গে রাজার
পরামর্শদাতা লর্ড চ্যান্সেলর দেখা করলেন। রাজা বললেন, আমি শীঘ্রই মারা যাব। ডিউক অব
নরফোকের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করতে হবে। তাই একটা মৃত্যুর পরোয়ানা লিখে নিয়ে এসো, আমি
তাতে আমার সিল দিয়ে দিই। রাজা বিছানায় উঠে বসতে চাইলেন কিন্তু দুর্বলতার জন্য পারলেন
না। কিন্তু বড় সিলটা অনেক খোঁজার পরও পাওয়া গেল না। রাজা মনে মনে বললেন, আমি রাজকুমারের
কাছে সিলটা রেখেছিলাম। কিন্তু রাজকুমারকে জিজ্ঞাসা করা হলো, সে বলল যে সে সীলটা কোথায়
রেখেছে তা মনে করতে পারছে না। আপাতত ছোট সীল দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া
হলো। রাজকুমারকে আনন্দিত রাখার জন্য তাকে নৌবিহারে নিয়ে যাওয়া হলো। কিন্তু এতসব আনন্দের
মধ্যে থেকেও সে সুখী হতে পারছিল না।
এদিকে সত্যিকারের
রাজকুমার রাস্তায় রাস্তায় লাঞ্ছিত হচ্ছিল। রাজকুমারকে এই লাঞ্ছনার হাত থেকে
বাঁচানোর জন্য একজন
জোয়ান এগিয়ে এসে সবাইকে বাধা দিল। ফলে সৈনিকের সঙ্গে বিদ্রুপকারীদের তর্ক শুরু হলো।
আর ঠিক এই সময় রাজার ঘোড়সওয়ারেরা সেই রাস্তায় তাদের মাঝখানে এসে পড়ল এবং সৈনিক ও রাজকুমার
সবার থেকে আলাদা হয়ে পালিয়ে গেল।
এর কিছুক্ষণ পর রাস্তায়
রাস্তায় এক ফরমান পাঠ করা হলো। এতে সবাইকে বলা হলো যে, রাজা মারা গিয়েছেন এবং রাজকুমার
এডওয়ার্ড নতুন রাজা হয়েছেন। টম তার উপদেষ্টা লর্ড হাটফোর্ডকে জিজ্ঞাসা করুনল, আমি যদি
এখন থেকে রাজা হয়ে থাকি তাহলে আমার আদেশ বহাল থাকবে। লর্ড হাটফোর্ড বললেন, নিশ্চয়ই
আপনার হুকুমই আইন। টম ক্যান্টি তখন বলল: আমার রাজত্ব হবে দয়ার, ক্ষমার। কোনো রক্তপাত
হবে না আমার রাজত্বে এবং নোরফোকের মৃত্যুদন্ড আমি তুলে নিয়ে তাকে মুক্ত করুনলাম।
(১১)
এদিকে রাজকুমার যখন
তার নতুন বন্ধুকে নিয়ে রাস্তায় হাঁটছিল তখন রাজার মৃত্যুসংবাদ শুনে সঙ্গে সঙ্গে বলে
উঠল, আমার বাবা মারা গিয়েছেন। নতুন সৈনিকটি বলল, ওহো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম যে তুমি
রাজকুমার এডওয়ার্ড, এ দেশের নতুন রাজা। সৈনিক মনে মনে ভাবছিল: আহা বেচারা, তার মাথাটা
একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। কিন্তু আমি সব অবস্থাতে এই ছেলেটিতে আপদে-বিপদে রক্ষা করে
যাব।
এরপর সৈনিকটি রাজকুমারকে
একটা সরাইখানাতে নিয়ে গেল। কিন্তু যেইমাত্র তারা সেখানে ঢুকতে যাবে তখনই টমের বাবার
সঙ্গে দেখা। সে এগিয়ে এসে বলল, এবার তুমি পালিয়ে যেতে পারবে না বাছাধন, তোমাকে আচ্ছা
করে পিটুনি দেব। সৈনিকটি লোকটিকে জিজ্ঞেস করুনল, ছেলেটি তোমার কী হয়? লোকটি উত্তর দিল,
এই বজ্জাত ছেলেটি আমার ছেলে। রাজকুমার বলে উঠল, মিথ্যা কথা, আমাকে যেন এই লোকটার জিম্মায়
ছেড়ে দিও না। সৈনিক বলল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তুমি আমার সাথেই থাকবে। জন ক্যান্টি
তখন গজরাতে গজরাতে বলল, আচ্ছা দেখা যাবে। সৈনিক তখন তার খাপ থেকে তলোয়ার বের করে বলল,
সাবধান একে ছুঁয়েছ কি তোমার একদিন কি আমার একদিন। এই ছেলে আমার তত্ত্বাবধানে থাকবে।
তুমি কি মনে করুনো তোমার মতো একজন জঘন্য ব্যক্তির হাতে একে ছেড়ে দেব? যাও এখান থেকে
সরে পড়ো, আর এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতেই চেষ্টা করুনো।
সৈনিক রাজকুমারকে
বলল, আমি থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে না বা কেউ জ্বালাতনও করতে পারবে না। রাজকুমার
বলল, সৈনিক তোমাকে ধন্যবাদ, আমি যখন আমার সিংহাসনে আরোহণ করুনব তখন তোমার কথা আমার
মনে থাকবে। তারপরে সরাইখানাতে যেয়ে রাজকুমার ঘুমাল আর সৈনিক তার জন্য একটা পোশাকের
ব্যবস্থা করার জন্য চলে গেল।
ভোরে সৈনিক নিজ হাতে
একটা পোশাক মেরামত করে নিয়ে ঘরে ঢুকে দেখে রাজকুমার বিছানায় নেই। তখন সে দৌড়ে সরাইখানাওয়ালার
কাছে গিয়ে হুমকি দিল। তখন সরাইখানাওয়ালা বলল, ও তো আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছে। আপনার
সংবাদবাহক এসে খবর দিয়েছে যে আপনি তাকে লন্ডন ব্রিজের ওখানে দেখা করতে বলেছেন।
সংবাদবাহক কি একা
ছিল?
হ্যাঁ, কিন্তু সে
যখন ছেলেটিকে নিয়ে চলে গেল তখন আরও একজন বদমাইশ প্রকৃতির লোক তাকে অনুসরণ করুনছিল।
একথা শুনে সৈনিক ছুটল
রাজকুমারের খোঁজে।
এদিকে নকল রাজকুমার
টম বিচার ও অন্যান্য রাজকার্য সমাধা করে যাচ্ছে। আর সত্যিকার রাজকুমার লন্ডন ব্রিজের
দিকে তার রাজপ্রাসাদের কারো সঙ্গে দেখা হবে এই আশায় সেদিকে চলেছে। হঠাৎ রাজকুমারের
কানে আসল, তোমার রক্ষক বন্ধু তোমাকে আর আজ রক্ষা করার জন্য আসছে না। রাজকুমার বলল,
এটা কোন ধরনের ধূর্ততা! তখন জন ক্যান্টি চাবুক হাতে এগিয়ে এসে বলল, নিশ্চয়ই তুমি তোমার
বাবাকে চিনতে ভুল করুনোনি। এখন এই গুদামঘরের ভিতর ঢোকো এবং যতদিন পর্যন্ত আমার জন্য
ভিক্ষা করতে রাজি না হবে এখানেই তোমাকে কাটাতে হবে। এদিকে সেই সৈনিক পইপই করে রাজকুমারকে
খুঁজছে। পরে সে অনুমান করুনল যে সেই বদমাইশ লোকটা যে তাকে ছেলেটির বাবা বলে পরিচয় দিতে
চেষ্টা করেছিল নিশ্চয়ই সে তাকে কোথাও আটকে রেখেছে। ভীত ও সন্ত্রস্ত রাজকুমার পুরাতন
গুদামের মধ্যে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
(১২)
হঠাৎ রাতে যখন তার
ঘুম ভাঙল তখন সে দেখল কয়েকজন চোরের এক সভা বসেছে। তারা সবাই চুরির জন্য নতুন নতুন উপায়
উদ্ভাবনে ব্যস্ত। রাজকুমারের দিকে চোখ পড়তেই তাকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে তার মাথায় এক ছেঁড়া
টুপি পরিয়ে দলের মাতবর বলল, আমি তোমাকে ফুফু দি ফাস্ট নামে নামকরুনণ করুনলাম। পরের
দিন ভোরে রাজকুমার ও তার সঙ্গী ছেলেটি ভিক্ষা করতে বের হলো। রাজকুমারকে ছেলেটি বলল,
তুমি আমাকে হিউগস বলে ডাকতে পারো। রাজকুমার বলল, কিন্তু আমি তোমার মতো ভিক্ষা করতে
পারব না। হিউগস বলল, তুমি এত সাধু হলে কবে থেকে? তোমার বাবা যে বলল, তুমি গত জীবনে
লন্ডনে ভিক্ষা করে কাটিয়েছ? রাজকুমার বলল, ঐ বদমাইশটা আমার বাবা নয়। এমন সময় হিউগস
বলল, শীঘ্র এদিকে আসো একজন ধনীলোক এদিকে আসছে। তোমাকে ভিক্ষা করতে হবে না। তুমি শুধু
ভান করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আর আমি মাটির উপর শুয়ে অজ্ঞান হবার ভান করুনব। যখন
ধনী লোকটি তোমার সামনের দিকে আসবে তখন হৈ-চৈ করে চিৎকার করে বলবে যে আমি তোমার ভাই
এবং আমরা কয়েকদিন কিছুই খাইনি। তারপর ছেলেটি রাজকুমারকে শাসিয়ে বলল, ঠিকমতো যদি কথা
না শোনো তাহলে তোমার শরীরের হাড়গুলো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করুনব।
ধনী ভদ্রলোকটি হিউগ্সের
কাছে এসে তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করুনল, তোমার কী হয়েছে? তখন সে বলল,
আমি এক গরিব ছেলে, অনাহারে ভুগছি, আমাকে দয়া করে একটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করুন লোকটি
বলল, আহা গরিব বেচারা, তোমায় একটা কেন তিনটা পয়সা দিয়ে সাহায্য করুনব। ছেলেটি বলল,
জনাব দয়া করে যদি আমাকে একটু ধরে ধরে আমার বাড়ি পৌঁছে দেন। এমনি সময় রাজকুমার চিৎকার
করে উঠল, ও আমার ভাই নয়, সে একজন ভিক্ষুক ও চোর, আপনি লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে, সে
আপনার পকেট কেটেছে। আপনার লাঠির এক বাড়িতে ওর সব ভান পালাবে। একথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে
হিউগ্স দৌড়ে পালাল।
রাজকুমার সুযোগ খুঁজছিল।
সে ভাবল এখন যদি আমি না পালিয়ে যাই তাহলে হিউগ্স ভিক্ষুকদের নিয়ে এসে আমায় তাড়া করুনবে।
সে সমস্তটা দিন কৃষকদের জমি চারিদিক দিয়ে ঘুরে বেড়াল। সন্ধ্যার দিকে এক বনের ধারে এসে
হাজির হলো। এখানে দূরে একটা কুটিরে আলো জ্বলতে দেখে সে সেখানে গিয়ে হাজির হলো। এই কুটিরটা
ছিল একজন ঋষিতুল্য সন্ন্যাসী। রাজকুমার ভিতরে গিয়ে পরিচয় দিল যে সে ইংল্যান্ডের রাজা।
কুটিরের ভিতরের সন্ন্যাসী বলল, আসো ভিতরে আসো। আমার এখানে কাউকে জায়গা দিই না, তবে
রাজার জন্য নিশ্চয়ই আমার জায়গা আছে। রাজকুমারকে সম্বোধন করে সন্ন্যাসী বলল, আমার তোমাকে
বিচার করার কাজ শেষ হয়ে গেছে। এখন আমি তোমাকে একটি গোপন তথ্য বলব, আমি সন্ন্যাসী নই।
আমি হলাম একজন ফেরেস্তা। তুমি তাহলে হেনরির ছেলে, সে কী বেঁচে আছে? রাজকুমার বলল, না
কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছে।
(১৩)
সন্ন্যাসী তাকে খাইয়ে
দাইয়ে বিছানায় ঘুমোতে দিয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে সন্ন্যাসী এসে তাকে বলতে লাগল, তুমি
তো জানো না তোমার বাবা আমার ওপর অত্যাচার করেছে। আমাকে ধর্ম থেকে বিতাড়িত করেছে। আমাকে
ও আমার অনুসারীদের দেশ থেকে তাড়িয়েছে। এই জঙ্গলে আমি পালিয়ে আছি। যখন বুঝতে পারল যে
রাজকুমার ঘুমিয়ে তখন সে বলল, যতক্ষণ বেঁচে আছ সুখস্বপ্ন দেখে নাও। এই বলে সে বড় পাথরে
ছুরি শান দিতে লাগল আর বলতে লাগল, তোমার বাবা আমার হাত থেকে বেঁচে গেছে, তুমি বাঁচবে
না। তারপর সে তার হাত পা ও মুখ দড়ি ও কাপড় দিয়ে বাঁধল। তারপর সন্ন্যাসী যেইমাত্র ছুরি
উঁচিয়ে রাজকুমারকে হত্যা করতে যাবে, ঠিক সেই মুহূর্তে দরজায় কে যেন কড়া নেড়ে জিজ্ঞাসা
করুনল, বাসায় কে আছে? রাজকুমার সেই স্বর শুনে ভাবল, এ তো সেই সৈনিক বন্ধুর গলা। সন্ন্যাসী
দরজা খুলে দিতেই সৈনিক জিজ্ঞাসা করুনল, ছেলেটি কোথায়? সন্ন্যাসী বলল, কোন ছেলে? তখন
সৈনিক রেগে গিয়ে বলল, যে ছেলেটা চুরি করেছিল তাকে আমি শাস্তি দিয়েছি। এখন তোমার এখানে
যে এসেছে সে ছেলেটি কোথায়?
সন্ন্যাসী প্রথমে
নানা কথা বলে তাকে ফাঁকি দিতে চাইল। কিন্তু সৈনিকের চাপের মুখে সন্ন্যাসী রাজকুমারকে
সৈনিকের হাতে তুলে দিল। সৈনিক তখন সেই কেনা পোশাক রাজকুমারকে পরিয়ে গ্রাম থেকে দুটি
গাধা কিনে এনে তাতে চড়ে শহরের দিকে রওনা হলো।
শহরে হেনডেন হলে এসে
তারা পৌঁছল। এই হেনডেন হলটা ছিল সৈনিকের বাড়ি। সৈনিক বাড়ির কড়া নাড়তেই তার ভাই বেরিয়ে
আসল। সৈনিক তখন বলল, আরে আমার ভাই। উহ্! প্রায় সাত বছর পরে তোমার সঙ্গে দেখা। কিন্তু
তার ভাই তাকে না চেনার ভান করে বলল, আপনি কে? সৈনিক বলল, আমি তোমার ভাই মিল। তুমি কি
আমাকে চিনতে পারছ না? তখন তার ভাই বলল, আমার ভাই! সে তো কবে প্রায় তিন বছর হলো যুদ্ধে
মারা গেছে। তুমি একজন জালিয়াত। সৈনিক বলল, তুমি মিথ্যা বলছ। ঠিক আছে তোমার বাবাকে ডাকো।
বাবা মারা গেছেন। উহ্! বড় দুঃখের সংবাদ, তাহলে লেডি এডিথকে ডাকো। কিছুক্ষণ পরে সৈনিকের
ভাই এক সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে হাজির হলো ও জিজ্ঞাসা করুনল, বলো তো এই লোকটাকে তুমি চেনো
কী না? লেডি এডিথ বলল, এ লোকটাকে জীবনে আমি কখনো দেখিনি। সৈনিক রেগে গিয়ে চিৎকার করে
বলল, বদমাইশ, মিথ্যুক, তুমি নিজে চিঠি লিখে জানিয়েছ যে আমি মরে গেছি এবং তারপর আমার
বাগদত্তাকে বিয়ে করেছ। আমার সামনে থেকে দূর হও, নচেৎ তোমায় আমি হত্যা করুনব। এই বলে
তার ভাইকে আক্রমণ করুনল।
আক্রান্ত ভাইয়ের চিৎকারে
সব চাকরুন এসে হাজির। তখন সৈনিকের ভাই হিউগ বলল, সব দরজা বন্ধ করে দাও যেন এই জালিয়াত
পালাতে না পারে। সৈনিক বলল, আমি পালাচ্ছি না, যে পর্যন্ত আমি ন্যায়মতো হেনডন হলের উত্তরাধিকারী
হচ্ছি। রাজকুমার বলল, সত্যি বড়ই আশ্চর্যের বিষয়। সৈনিক বলল, হিউগ ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ
আর জোচ্চোর স্বভাবের ছিল। রাজকুমার বলল, আমি ভাবছি যে আমাকে খোঁজার জন্য এখনো কোনো
সৈন্য পাঠানো হলো না কেন? সৈনিক মনে মনে বলল, আহা! বেচারার রাজকীয় দুঃস্বপ্ন এখনও যায়নি।
রাজকুমার বলল, আমি আমার সমস্ত ঘটনা এ কারণে লিখে রেখেছি। এটা তুমি আগামীকাল আমার চাচা
লর্ড হাটফোর্ডের কাছে পৌঁছে দেবে। সৈনিক বলল, ঠিক আছে।
(১৪)
ঠিক এমনই সময় একটা
নারীকন্ঠ ভেসে আসল: দয়া করে একটু থামুন স্যার। সৈনিক বলল,বাগদত্তা বধূ এডিথ, তুমি এখনো
আমাকে না চেনার ভান করুনছ। এডিথ বলল, আমি দুঃখিত স্যার, না, আমি না-চেনার ভান করুনছি
না। আমি আপনার জন্য সমবেদনা অনুভব করুনছি। কারণ আপনি মিলসের মতো দেখতে। আপনি আমার স্বামীকে
বিরক্ত করলে সে আপনাকে হত্যা করুনবে। সৈনিক বলল, না একথা সত্যি নয়। তুমি সমবেদনা জানাতে
আসনি, তুমি আমায় ভালোবাস তাই এসেছ।
ঠিক এমনি সময় পুলিশ
এসে দরজা খুলে সৈনিক ও রাজকুমারকে জেলখানায় নিয়ে গেল। জেলখানায় তাদের কয়েকদিন কাটল।
তারপর একদিন একজন পুরোনো চাকরুন এসে সৈনিকের সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করুনল। সে বলল, হুজুর
আমি মনে করেছি আপনি মারা গেছেন। আপনাকে আবার জীবিত দেখলাম এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে
আনন্দের দিন। সৈনিক বলল, এন্ড্রু আমি জানতাম তুমি আমার বিরুদ্ধে যাবে না।
প্রতিদিনই এন্ড্রু
সৈনিকের সঙ্গে দেখা করে খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে যেতে লাগল। এন্ড্রু
বলল, এডিথ হিউগকে বিয়ে করেছে কিন্তু সে মোটেও সুখী নয়। সে এখনো আপনাকে ভালোবাসে। আপনার
ভাই হিউগ আমাদের শাসিয়েছে আমরা কেউ যদি আপনাকে চিনি বলে পরিচয় দিই তাহলে সে আমাদের
হত্যা করুনবে। এখন রাজার অভিষেক হবার পরে নতুন রাজার অনুগ্রহে সে অনেক কিছু করুনবে
বলে আশা করুনছে।
রাজকুমার জিজ্ঞাসা
করলেন অভিষেক উৎসব কবে? সৈনিক মিলসকে বলল, তারা আর কাউকে সিংহাসনে বসাচ্ছে। আমাদের
ওয়েস্টমিনিস্টার গির্জায় যেতে হবে এবং যে করেই হোক এই অভিষেক উৎসব বন্ধ করতে হবে। সৈনিক
বলল, কালই আমার বিচার হবে, ঠিক সময়মতোই সেখানে পৌঁছাতে পারব।
পরের দিন বিচারে মিলের
দুদিনের জেল হবার আদেশ শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমার বললেন, হে জজ, আপনি কেমন করে এর
প্রতি অবিচার করতে পারেন? আমি আপনাকে হুকুম দিচ্ছি একে মুক্তি দিন। বিচারক সঙ্গে সঙ্গে
বললেন যে এই বোকা ছেলেটাকে কয়েক ঘা বেত লাগাও। তাহলে তার জিহবা সংযত হবে। সৈনিক নিজে
বিচারকের কাছে মিনতি করুনল যে বালকটি বড় দুর্বল। বালকের ভাগের চাবুক আমাকে মারার অনুমতি
দিন।
উত্তম প্রস্তাব, এই
বেওকুফকে এক ডজন চাবুক কষে লাগাও। চাবুক খাওয়া শেষে জেলখানার ভিতরে রাজকুমার সৈনিককে
বলল, তুমি সব লোক থেকে মহান এবং তোমাকে আজ থেকে আরল খেতাবে ভূষিত করুনলাম।
দুইদিন পরে তারা দুজনেই
কারামুক্ত হয়ে লন্ডনের পথে রাজার অভিষেক দেখার জন্য রওনা হলো। সৈনিক ভাবছিল এ যাত্রায়
দুটা কাজ হবে। এক : রাজকুমারের ইচ্ছা পূরণ হবে, আর দুই : আমার বাবার এক পুরোনো বন্ধুর
সঙ্গে রাজপ্রাসাদে আমার দেখা হয়ে যাবে। তারা লন্ডনে ঢোকার পরে দেখল সবাই উৎসব মেতে
আছে। হঠাৎ একজন বলে উঠল, তুমি ধাক্কা দিয়ে আমার হাতের পেয়ালা ফেলে দিলে কেন? অন্যজন
উত্তর দিল যে সে ইচ্ছা করে ধাক্কা দেয়নি। এখন তুমি কী করতে চাও?
(১৫)
এমনিভাবে কথা কাটাকাটি
করতে করতে শেষে হাতাহাতি শুরু হলো এবং সব লোক এই গন্ডগোল দেখে এদিকে-সেদিকে ছুটে পালাতে
লাগল। এর মধ্যে সৈনিক ও রাজকুমার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। যাক, গন্ডগোল শেষে খুঁজে পাওয়া
যাবে এই মনে করে রাজকুমার একাই নিজে অভিষেক দেখার জন্য রাজপ্রাসাদের দিকে রওনা হলো।
পথ চলতে চলতে রাজ্যের সব অনাচার তার চোখের উপর ভেসে উঠল। আর সে মনে মনে ভাবছিল যে আমি
সিংহাসনে আরোহণ করার পরে এইসব অন্যায় ও অনাচার দূর করতে চেষ্টা করুনব।
এদিকে রাজপ্রাসাদে
টম ক্যান্টির জন্য আজ দিনটা বড় আনন্দের। তাকে ভালো ভালো কাপড় পরানো হলো। বিভিন্ন খাবারও
এল। সে মনে মনে ভাবল রাজা হওয়ায় ভারি মজা এবং অভিষেকে যাবার পথে সে আরও আনন্দিত হলো।
তার হাতে কয়েক থলি মুদ্রা গরিবের মধ্যে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করার জন্য দেয়া হলো। সে
গাড়িতে বসে ছুড়ে ছুড়ে তা বিতরণ করুনছিল। এমনি সময় ভিড়ের মধ্যে সে তার মাকে দেখতে পেল
এবং তার অজান্তেই তার হাত মাথায় চলে গেল। এদিকে তার মাও তাকে চিনতে পারল, ‘টম আমার
টম’ বলে গাড়ির দিকে ছুটে আসছিল কিন্তু গাড়ির প্রহরীরা তাকে আটকে ফেলল। তখন টম তার মন্ত্রণাদাতাকে
বলল, এই প্রৌঢ় মহিলাটি আমার মা। এই কথা শুনে হাটফোর্ড তাড়াতাড়ি আর্চ-বিশপের সঙ্গে পরামর্শ করে বলল যে, রাজকুমারের পাগলামিটা আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কাজেই অভিষেকের
কাজটি তাড়াতাড়ি শেষ করলেই ভালো হয়।
এই কথা অনুযায়ী অনুষ্ঠানটি
খুব তাড়াতাড়ি চলতে লাগল। তারা সবাই যখন দরবার কক্ষে এসে পোঁছাল ঠিক সেই সময় হঠাৎ এক
বালককণ্ঠে উচ্চারিত হলো: থামো, আমিই হলাম আসল রাজকুমার। দরবারের মধ্য থেকে কেউ কেউ
বলে উঠল, এই ভিক্ষুক ছেলেটাকে বের করে দাও। কিন্তু সিংহাসন থেকে টম বলে উঠল, না না,
সেই সত্যিকারের রাজকুমার। টম ক্যান্টি তখন সব ঘটনা হাটফোর্ডকে খুলে বলল। তখন হাটফোর্ড
বললেন, এ যে অবিশ্বাস্য ঘটনা। তবে এই ব্যাপারে একটা মাত্র পরীক্ষা হবে-যার দ্বারা এই
ঘটনার ফয়সালা হবে যে কে সত্যিকারের রাজকুমার। তারপর তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, বলোতো বড়
রাজকীয় সিলটা কোথায় আছে?
ভিখারি রাজকুমার বলল,
এ তো অতি সাধারণ প্রশ্ন। আমার কামরায় গিয়ে টেবিলের বামদিকে একটা লোহার পেরেক আছে, সেটা
চাপ দিলে একটা গুপ্ত আলমারির দরজা খুলে যাবে, সেখানেই সিলটা পাবেন। হাটফোর্ড তড়িৎ সিল
আনার জন্য চলে গেল কিন্তু কিছুক্ষণ পর খালি হাতে ফিরে এসে বলল, সিলটা পাওয়া গেল না।
তখন হাটফোর্ড বললেন, এতে শুধু একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়। ভিখারি রাজকুমার হাটফোর্ডকে
প্রশ্ন করুনল, আপনি ঠিকমতো খুঁজে দেখেছেন তো? হাটফোর্ড বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু কোথাও
সেই বড় সোনালি গোল সীলটা পাওয়া গেল না। টম বলল, একটা বড় সোনালি গোল সিলের কথা বলছেন,
আরে তোমার টেবিলের উপরই ছিল এবং পরে তুমি সেটাকে লুকালে। ভিখারি রাজকুমার বলল, আর বলতে
হবে না মনে পড়ছে। হাটফোর্ড আমার ঘরে যে লোহার বর্ম আছে তার বাহুর তলে বড় সোনালি সিলটা
আছে। আবার হাটফোর্ড দৌড়ে সীলটা খুঁজতে গেল এবং তাড়াতাড়িই ফেরত এসে বলল, আপনাকে সন্দেহ
করার জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন হুজুর।
(১৬)
এর মধ্যে সৈনিক মিলস
হেনডেন একদিন পরে এসে প্রাসাদে পৌঁছোল। দ্বারী তাকে জিজ্ঞাসা করুনল, তুমি এখানে কী
করুনছ? সৈনিক বলল, আমি আমার স্বর্গীয় পিতার বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। দ্বারী বলল,
লোকটাকে সন্দেহ হচ্ছে, তোমরা একে তল্লাশি করুনো। তারা তার দেহ তল্লাশি চালিয়ে একটা
পত্র পেল। তাতে লেখা : ‘লর্ড হাটফোর্ড সমীপেষু, এই পত্রবাহক আমার বন্ধু স্যার মিলস
হেনডেন।’
সৈনিক মিলসকে রাজকুমারের
কাছে নিয়ে যাওয়া হলো। সৈনিক তখন ভাবছে : আমি কি স্বপ্ন দেখছি, না সত্যি? তখন রাজকুমার
বলল, হ্যাঁ মিলস, তুমি আমার পাশে বসো, এই অধিকার তোমাকে আগে দেওয়া হয়েছে। তারপর হিউজ
হেনডেনকে রাজ্য হতে বিতাড়িত করা হলো।
তার মৃত্যুর পরে মিলসের
সঙ্গে এডিথের বিয়ে হলো। সে তার মা ও বোনদের রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে বসবাস করতে লাগল।
রাজকুমারকে যারা সাহায্য করেছিল। সবাইকে পুরস্কৃত করা হলো। আর যারা তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার
করেছিল তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হলো।
রাজা এডওয়ার্ডের রাজত্ব
খুব ন্যায় ও শান্তির রাজত্ব ছিল। একদিন রাজকুমার টমকে জিজ্ঞাসা করুনল, তুমি আমার বড়
গোল সীলটার কথা কীভাবে মনে রাখলে? টম বলল, মনে থাকবে না? ওটা দিয়ে তো আমি প্রতিদিন
বাদামের খোসা ছাড়াতাম ও বাদাম ভাঙতাম। এটাকে আমি হাতুড়ির মতোই ব্যবহার করেছি।
সার-সংক্ষেপ
প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে
ষোড়শ শতাব্দীতে লন্ডনে এক রাজকুমার ভিখারির ছেলে এবং ভিখারির ছেলে রাজকুমার হয়ে গিয়েছিল।
ভিখারির ছেলের জন্ম হয়েছিল লন্ডনের এক বস্তিতে এবং রাজকুমারের জন্ম হয়েছিল রাজপ্রাসাদে।
ভিখারির ছেলের নাম
টম ক্যান্টি। সে বস্তিতে বড় হতে লাগল এবং বিভিন্ন লোকের কাছে ভিক্ষা শিক্ষার পাঠ নিতে
লাগল। রাজকুমার রাজপ্রাসাদে বড় হতে লাগল এবং বড় বড় পন্ডিতদের কাছ থেকে বিদ্যাশিক্ষা
নিতে লাগল। টম ছিল খুব কল্পনাবিলাসী। সে নিজেকে সত্যিকার রাজকুমার বলে কল্পনা করুনত
এবং সমবয়সীদের নিকট রাজকুমারকে দেখার ইচ্ছা পোষণ করুনত। সেজন্য একদিন হাঁটতে হাঁটতে
রাজপ্রাসাদের কাছে এসে গেট দিয়ে এক সুন্দর পোশাক পরা বালককে দেখল। সে ভাবল এ নিশ্চয়
রাজকুমার। এমন সময় দারোয়ান এসে তাকে পদাঘাত করুনল। রাজকুমার তা দেখে দারোয়ানকে খুব
বকা দিয়ে টমকে রাজপ্রাসাদের ভেতর নিয়ে গেলেন। দুজনে অনেক গল্প করুনল। টম তার জীবনের
গল্প এবং রাজকুমার তার জীবনের গল্প একে অপরকে বলল। টমের কাছে সব স্বপ্নের মতো মনে হলো।
একজনের কাছে অন্যজনের জীবন ভালো লাগায় তারা পোশাক বদল করুনল। রাজকুমার হলো ভিখারির
ছেলে আর ভিখারি হলো রাজার ছেলে। টম চলে গেল রাজপ্রাসাদে আর রাজকুমার বেরিয়ে এল রাস্তায়।
দুজনের নতুন জীবনে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে, তারা যাতে বুঝতে পারে তাদের স্ব স্ব জীবনই তাদের
জন্য আনন্দদায়ক। পরে বিভিন্ন চড়াই-উৎরাই পার হয়ে দুজনেই নিজেদের আগের জীবনে ফিরে এল।
0 Comments