আইনী-পর্যালোচনাঃ শ্রম আইন- অসদাচরনের তদন্ত যথাযথ না হলে তার প্রতিকার (Unlawful dismissal and its remedy) by Uttam Kumar Das

সমস্যাঃ

ঘটনাটি নিয়ে একাধিক ব্যাক্তি টেলিফোনে ও সরাসরি যোগাযোগ করেছেন- তাঁরা সকলে একটি কারখানায় কাজ করতেন। চাকরীর বয়স বিভিন্ন রকম- তিন থেকে সাত বছর। তাঁদের কারখানায় মাস তিনেক আগে একটি মারামারির ঘটনা ঘটে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু শ্রমিককে বরখাস্ত করা হয়েছে। তাঁদের মতে, যদিও তদন্ত হয়েছে, তবে তা দায়সারাভাবে করা হয়েছে- কাগজে-কলমে। মাত্র ৯ দিনে অভিযোগ আনয়ন থেকে বরখাস্ত আদেশ জারী- সব কিছু। এর কোন প্রতিকার আছে কি না?

 

উত্তরঃ

[উক্ত বিষয় নিয়ে আমরা আগেও পর্যালোচনা এবং বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ প্রকাশ করেছি।  তবে প্রাপ্ত ঘটনার ব্যাপকতা ও গুরুত্ব এবং জনস্বার্থ বিবেচনায় আমরা আবার এই পর্যালোচনা প্রকাশ করছি।  এতে ব্যক্তিগত নাম-পরিচয়সহ গোপন তথ্য প্রকাশ করা হলোনা এবং সংশ্লিষ্টদের অনুমতি নিয়েই এই পর্যালোচনা প্রকাশ করা হ’ল। সংশ্লিষ্ট ভুক্তভোগীসহ অন্যদের জ্ঞাতার্থে এবং জনসচেতনটায় এই প্রয়াস]। কোন চাকরীজীবীর ক্ষেত্রে বরখাস্ত মৃত্যুদণ্ডসম। কেউ অসদাচরণ করলে তার জন্য তদন্ত অত্যাবশ্যক। এতে দোষ প্রমাণ হলে তবেই বরখাস্ত। এই ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান ও ন্যায় বিচারের নীতি মানা আবশ্যক।

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০১৩ সনের সংশোধনীসহ) একজন শ্রমিকের (বা কর্মীর) বিরুদ্ধে কি-ভাবে অসদাচরণের অভিযোগ উত্থাপন করতে হবে এবং কি-ভাবে তার সুরাহা করতে হবে তার বিধান দিয়েছে। এর সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ এর বিধান।কোন কোন বিষয় অসদাচরনের আওতায় পড়বে তা শ্রম আইনের ২৩(৪) ধারায় তালিকাবদ্ধ করা হয়েছেঃ

(ক) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আইনসঙ্গত বা যুক্তিসঙ্গত আদেশ না মানা। তা কোন শ্রমিকের এককভাবে কিংবা সংঘবদ্ধ হয়ে অবাধ্যতা।

(খ) মালিকের ব্যবসা বা সম্পত্তি চুরি, আত্মসাৎ, প্রতারণা বা অসাধুতা।

(গ) শ্রমিকের নিজের বা অন্যের চাকরী সংক্রান্ত বিষয়ে ঘুষ নেয়া বা দেয়া।

(ঘ) ছুটি-ছাড়া অভ্যাসগত অনুপস্থিতি অথবা ছুটি না নিয়ে এক সঙ্গে ১০ দিনের বেশী অনুস্থিতি।

(ঙ) অভ্যাসগত দেরীতে অনুপস্থিতি।

(চ) প্রতিষ্ঠানে প্রযোজ্য কোন আইন, বিধি বা প্রবিধানের লঙ্ঘন।

(ছ) প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খল বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুর।

(জ) কাজে-কর্মে অভ্যাসগত গাফিলতি।

(ঝ) অনুমোদিত চাকরী সংক্রান্ত, শৃঙ্খলা বা আচরণসহ, যে কোন বিধির অভ্যাসগত লঙ্ঘন।

(ঞ) মালিকের অফিসিয়াল রেকর্ডের রদবদল, জালকরণ, অন্যায় পরিবর্তন, উহার ক্ষতিকরণ বা হারিয়ে ফেলা।

কোন শ্রমিক উপরের যে কোন অপরাধ করলেও তাকে সরাসরি শাস্তি দেয়া যাবেনা; আগে নীচের ধাপসমূহ পালন করে তাঁর বিরুদ্ধে প্রাপ্ত অসদাচরণের অভিযোগের যথাযথ তদন্ত করতে হবে এবং দোষ প্রমাণ হলে তারপরই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যাবে [শ্রম আইনের ২৪(১) ধারা]। অবশ্য পালনীয় ধাপসমূহ নীচে দেয়া হ’ল-

(ক) লিখিতভাবে অভিযোগ করা।

(খ) সংশ্লিষ্ট অভিযোগের একটি কপি অভিযুক্তকে দেয়া এবং তার জবাব দেয়ার জন্য অন্ততঃ সাতদিন সময় দেয়া (সাত কর্ম- দিবস নয়)।

(গ) শুনানীর সুযোগ দান।

(ঘ) মালিক ও শ্রমিকের সম-সংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে তদন্ত কমিটির তদন্তে অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হওয়া।

(ঙ) মালিক বা ব্যবস্থাপক বরখাস্তের আদেশ অনুমোদন করা।

আর এই তদন্ত ৬০ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। এখানে আইনের উদ্দেশ্য হ’ল অভিযুক্তকে যাতে করে ঝুলিয়ে না রাখা হয় সে জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে।

অসদাচরনে অভিযোগে অভিযুক্ত কোন শ্রমিককে তদন্ত সাপেক্ষে সাময়িক বরখাস্ত করা যা। তবে অভিযোগের বিষয় আদালতে বিচারাধীন থাকলে সাময়িক বরখাস্ত করা যাবেনা। আর সাময়িক বরখাস্তের মোট মেয়াদ ৬০ দিনের অধিক হবে না।

তার মানে কোন ক্ষেত্রে সাময়িক বরখাস্ত ৬০ দিনের বেশী হলে তা অবৈধ হবে- সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত শ্রমিক এই মর্মে অনুযোগ দিতে এবং তাঁকে অবিলম্বে পুনর্বহালের দাবী করতে পারবেন।

অসদাচরনের অভিযোগ আনয়ন, তদন্ত, বরখাস্ত-আদেশ অনুমোদন এবং জারীর মাধ্যমে তা কার্যকর করা- সকল ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা এবং ন্যায় বিচারের নীতি অনুসরণ করার কথা বলা হয়েছে। প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন মামলার রায়ে মাননীয় উচ্চ আদালত এসব সিদ্ধান্ত ও পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এর জন্য কোন সরল-ফর্মুলা নেই। সংশ্লিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষাপট ও কার্যকারণের নিরিখে তা করতে হবে। যিনি অভিযোগ আনবেন, আইনের আলোকে তার সুরাহা ও শাস্তি বিধান (যদি আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়) তার দায়িত্ব।

এক্ষেত্রে যদি দেখা যা যে অভিযোগ আনয়ন, তদন্ত বা শাস্তি বিধান- এর কোন পর্যায়ে আইনের বিধান কিংবা ন্যায় বিচারের নীতি অনুসরণ করা হয়নি তবে তা চ্যালেঞ্জ করা যাব। তখন বরখাস্ত আইনসঙ্গত না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট শ্রমিক তাঁকে স্বপদে বহাল কিংবা মালিক কর্তৃক তাঁর চাকরী অবসানের অর্থাৎ টার্মিনেশন সুবিধা দাবী করতে পারবেন।

আলোচ্য ঘটনায় প্রাপ্ত কাগজপত্রে দেখা যায় (এখানে নমুনা হিসেবে একজনের অভিযোগপত্র নেয়া হ’ল)- একজনকে কোন মাসের ০১ তারিখ অভিযোগপত্র ইস্যু করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে ঘটনার তারিখ থাকলেও কোন সময় উল্লেখ নেই। কারখানার কোন স্থানে কথিত ঘটনা ঘটেছে তার উল্লেখ নেই। মূল্যমান যন্ত্রপাতি “ভাংচুরের” কথা থাকলেও সেগুলোর কোন নাম নেই।

সব চেয়ে মারাত্বক হ’ল- “… এই পত্র প্রাপ্তির ০৮ (আট) কর্মদিবসের মধ্যে আপনার বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না, তার কারন দর্শানোর জন্য বলা হল। আপনার জবাব উক্ত সময়ের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট অবশ্যই পৌঁছাতে হবে …”।

ভাল কথা- আইনে বলা আছে জবাবদানের জন্য অন্ততঃ সাতদিন সময় দিতে হবে; এখানে আট কর্ম-দিবস দেয়া হয়েছে, যা বেশী। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু যখন বলা হ’ল- “…আপনার জবাব উক্ত সময়ের মধ্যে নিম্ন স্বাক্ষরকারীর নিকট অবশ্যই পৌঁছাতে হবে …”। তার মানে কি হ’ল। অভিযুক্তকে কি তাঁর জবাব দেওয়ায় জন্য আইন-নির্ধারিত সময় দেয়া হ’ল? এখানে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে।

ভুক্তভোগীদের আরও অভিযোগ তাঁদের স্বাধীনভাবে জবাব দিতে দেয়া হয়নি। আগে থেকে টাইপ করে রাখা কাগজে কিছু শূন্য জায়গায় তাঁদের নাম-পদবি লিখে তাতে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা হয়।

প্রাপ্ত কাগজপত্র পর্যালোচনায় দেখা গেল- একটি টাইপ করা কাগজ, তাতে অভিযুক্তের দোষ স্বীকার করামূলক বক্তব্য। অবাক করা বিষয় হ’ল প্রাপ্ত “জবাবের” সবগুলি একই, শুধুমাত্র নাম-পদবি, স্বাক্ষর প্রভৃতি বাদে।

শ্রম বিধি অনুসারে, অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে তদন্ত কমিটিতে তাঁর প্রতিনিধি লিখিতভাবে মনোনয়ন দেয়ার সুযোগ দিতে হবে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দেখা গেল- ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ যে “তদন্ত নোটিশ” ইস্যু করেছেন তাতে অভিযুক্তের প্রতিনিধির নামও।

আবার, যেখানে অভিযুক্তকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে কারখানায় আসতে মানা করা হয়েছে সেখানে কথিত তদন্ত নোটিশ ইস্যু করার পরদিনই সকাল ১১ টায় তদন্ত কমিটির বৈঠক ডাকায় প্রশ্ন আসবে কখন ঐ চিঠি বিলি হ’ল? প্রস্তুতি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, সাক্ষী যোগাড়ের সময় কোথায়?

প্রাপ্ত কাগজপত্রের পর্যালোচনায় দেখা গেল- অভিযোগপত্র, অভিযুক্তের জবাব, তদন্ত কমিটির কার্যধারা, বরখাস্ত-নোটিশ প্রভৃতিতে কথিত ঘটনার বর্ণনার মধ্যে মিল নেই। এতে করে পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে অসামঞ্জস্য দৃশ্যমান।

বরখাস্তকৃত শ্রমিকের প্রাপ্যঃ

তদন্তে অভিযুক্ত শ্রমিক (বা কর্মী) দোষী সাব্যস্ত হলে আগে কর্তৃপক্ষকে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদন গ্রহণ/অনুমোদন করতে হবে। তার ভিত্তিতে হবে বরখাস্ত আদেশ এবং তার যথাযথ জারীকরণ।

সংশ্লিষ্ট শ্রমিক মালিকের ব্যবসা বা সম্পত্তি চুরি, আত্মসাৎ, প্রতারণা বা অসাধুতা কিংবা প্রতিষ্ঠানে উচ্ছৃঙ্খল বা দাঙ্গা-হাঙ্গামা, অগ্নিসংযোগ, ভাংচুরের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে বরখাস্ত হলে কোন ক্ষতিপূরণ পাবেন না [শ্রম আইনের ২৩ (৩) ধারা]।

 

আর দোষী সাব্যস্ত হয়ে অপসারিত হলে ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রতি পূর্ণ বছর চাকরীর জন্য ১৫ দিন হারে মজুরী পাবেন [২৩(৩) ধারা]। এই ক্ষেত্রে কমপক্ষে এক বছর চাকরীর বয়স হতে হবে। আর শ্রম আইনে এক বছরের হিসাব হ’ল- পূর্ববর্তী ১২ পঞ্জিকা মাসে কমপক্ষে ২৪০ দিন কাজ (১৪ ধারা)। আর এখানে মজুরী বলতে আগের ১২ মাসের মূল মজুরী এবং মহার্ঘ ভাতা এবং এডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরীর (যদি থাকে) গড়কে বুঝাবে।

তবে যে কারণেই বরখাস্ত করা হোক না কেন সংশ্লিষ্ট শ্রমিক তার খোরাকী ভাতা বাবদ পাওনা, বকেয়া মজুরী ও ওভারটাইম বাবদ পাওনা (যদি থাকে), অব্যবহত অর্জিত ছুটি বাবদ পাওনা প্রভৃতি পাবেন।

বরখাস্ত যথাযথ না হলে তার প্রতিকারঃ

সংশ্লিষ্ট শ্রমিক যদি মনে করেন যে বিরুদ্ধে আনীত অসদাচরণের অভিযোগ যে প্রক্রিয়া তদন্ত হয়েছে তা যথাযথ হয়নি- এতে শ্রম আইনের ২৪ ধারা ও শ্রম বিধিমালার বিধান এবং ন্যায় বিচারের নীতির ব্যত্যয় হয়েছে তবে তিনি প্রতিকার চাইতে পারেন। বরখাস্ত আদেশ পাওয়ার কিংবা সংক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ জানার ৩০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মালিকের বরাবরে অনুযোগ দিতে পারেন। এতে যথাযথ প্রতিকার না পেলে তিনি মাননীয় শ্রম আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন (শ্রম আইন, ৩৩ ধারা)। রিট আবেদনের মাধ্যমে মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগেরও দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে। “মাওলানা আব্দুল হাকিম বনাম বাংলাদেশ” মামলার রায় সে পথ খুলে দিয়েছে [(২০১৪) ৩৪ বিএলডি (হাই কোর্ট বিভাগ) ১২৯]। এই ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন মাননীয় বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।

 

এই পর্যালোচনার জন্য আইনী মতামত দিয়েছেন-

ড. উত্তম কুমার দাস। তিনি মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগের আইনজীবী এবং শ্রম আইনে বিশেষজ্ঞ। তিনি শ্রম আইন বিষয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তবে এখানকার মতামত তাঁর ব্যাক্তিগত এবং একজন আইনজীবী হিসেবে প্রদত্ত।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ 

এটি কোন পূর্ণাংগ আইনী সমাধান নয়। প্রাপ্ত ঘটনার আলোকে মতামত মাত্র। আপনার কোন সমস্যা থাকলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অভিজ্ঞ কোন আইনজীবীর পরামর্শ নিন। সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন থাকলে আমাদের লিখে জানাতে পারেন; সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ আইনজীবীরা 

মতামত বা পরামর্শ দিবেন, আর তা সম্পূর্ণ বিনা-খরচেঃ thelawyersbd@gmail.com। ধন্যবাদ।

 

Post a Comment

0 Comments