কারখানা বন্ধ হলে শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী শ্রমিকরা কী পাবে? By অনুপম সৈকত শান্ত

তোবা গার্মেন্টে অনশন আন্দোলন চলাকালে শ্রমিকদের অনেকেরই জিজ্ঞাসা ছিল কারখানা বন্ধ হলে কী হবে? তোবার কারখানা বন্ধ। বন্ধ কারখানার মালামাল, যন্ত্রপাতি খুলে নিয়ে অন্য কারখানায় স্থাপন করা হচ্ছে। এর অর্থ হলো- এই কারখানাটি চালু করার ইচ্ছা কর্তৃপক্ষের নেই। যদি কারখানা আর না-ই খোলা হয়, তাহলে দেশের আইনে শ্রমিকদের রক্ষার জন্য কী আছে, সেটাই এখন মুখ্য আলোচনা।
দিনের পর দিন কারখানা বন্ধ রাখতে রাখতে কারখানা একেবারে বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়ে সরাসরি বা স্পষ্টভাবে কোনো কিছু উল্লেখ নেই শ্রম আইন ২০০৬-এ। তবে শ্রমিককে কাজ দিতে মালিকের ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতাকে ধারা ২/৫৮ মোতাবেক 'লে-অফ' বলা হয়েছে, 'লে-অফ' করতে হলে মালিককে সেটা ঘোষণা করতে হবে। তোবার কারখানাগুলো বন্ধ থাকাটা আমার কাছে অঘোষিত 'লে-অফ' পরিস্থিতি মনে হয়েছে।
ধারা ২/৫৮ : 'লে-অফ অর্থ কয়লা, শক্তি বা কাঁচামালের স্বল্পতা অথবা মাল জমিয়া থাকা অথবা যন্ত্রপাতি বা কলকবজা বিকল বা ভাঙ্গিয়া যাওয়ার কারণে কোনো শ্রমিককে কাজ দিতে মালিকের ব্যর্থতা, অস্বীকৃতি বা অক্ষমতা' হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তোবার কারখানায় ওপরের এসবের কিছুই হয়নি। ফলে এ যুক্তিতে কিভাবে কারখানা লে-অফ ঘোষণা করবে কর্তৃপক্ষ?
লে-অফের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আইনে বলা হয়েছে, 'সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরি এবং মহার্ঘ ভাতা এবং অ্যাড হক বা অন্তর্বর্তী মজুরি যদি থাকে, এর অর্ধেক এবং তাহাকে লে-অফ করা না হইলে তিনি যে আবাসিক ভাতা পাইতেন, তাহার সম্পূর্ণের সমান।' এর অর্থ হলো, যে কদিন লে-অফ থাকবে (সাপ্তাহিক ছুটি বাদে) সে কদিনের মূল বেতন, মহার্ঘ ভাতা, অ্যাড হক মজুরির অর্ধেক পাবে + আবাসিক ভাতার পুরোটা পাবেন। এ ক্ষেত্রে অবশ্য একটা বাধ্যবাধকতা আছে- মালিককে লে-অফ ঘোষণা করতে হবে কারখানা খোলার তারিখসহ।
কারখানা যদি স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়, সে ক্ষেত্রে কী হবে?
শ্রম আইন ২০০৬-এর ১৬/৪-এর ধারায় বলা হচ্ছে, 'মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে ভিন্নরূপ কোনো চুক্তি না থাকিলে, কোনো শ্রমিক এই ধারার অধীন কোনো পঞ্জিকা বৎসরে পঁয়তাল্লিশ দিনের অধিক সময়ের জন্য ক্ষতিপূরণ পাইবেন না।' এই আইনের ১৬/৫ : ধারার (৪) উপধারায় আরো বলা হচ্ছে, এ আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, যদি কোনো পঞ্জিকা বৎসরে কোনো শ্রমিককে অবিচ্ছিন্নভাবে বা বিচ্ছিন্নভাবে পঁয়তাল্লিশ দিনের অধিক সময়ের জন্য লে-অফ করা হয় এবং উক্ত পঁয়তাল্লিশ দিনের পর লে-অফের সময় যদি আরো পনেরো দিন বা তদূর্ধ্ব হয়, তাহা হইলে উক্ত শ্রমিককে, শ্রমিক এবং মালিকের মধ্যে ভিন্নরূপে কোনো চুক্তি না থাকিলে, পরবর্তী প্রত্যেক পনেরো বা তদূর্ধ্ব দিনসমূহের লে-অফের জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করিতে হইবে।' আইনের ১৬/৬ ধারার (৫) উপধারায় বলা হচ্ছে, উল্লিখিত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ হইবে সংশ্লিষ্ট শ্রমিকের মোট মূল মজুরি এবং মহার্ঘ ভাতা ও অ্যাড হক বা অন্তর্বর্র্তী মজুরি, যদি থাকে, এর এক-চতুর্থাংশ এবং যদি আবাসিক ভাতা থাকে, তাহার সম্পূর্ণের সমান।'
এ আইনের ১৬/৭ ধারায় আরো বলা হয়েছে, 'কোনো ক্ষেত্রে যদি কোনো শ্রমিককে কোনো পঞ্জিকা বৎসরে উপরে উল্লিখিত প্রথম পঁয়তাল্লিশ দিন লে-অফের পর কোনো অবিচ্ছিন্ন পনেরো দিন বা তদূর্ধ্ব সময়ের জন্য লে-অফ করিতে হয়, তাহা হইলে মালিক উক্ত শ্রমিককে লে-অফের পরিবর্তে ধারা ২০ এর অধীন ছাঁটাই করিতে পারিবেন।'
অর্থাৎ, লে-অফের প্রথম ৪৫ দিন শ্রমিকরা ক্ষতিপূরণ পাবেন বেসিক + মহার্ঘ ভাতা + অ্যাড হক মজুরির অর্ধেক + আবাসিক ভাতার পুরোটা, তার পরের ১৫ দিন পাবেন- বেসিক + মহার্ঘ ভাতা + অ্যাড হক মজুরির এক-চতুর্থাংশ + আবাসিক ভাতার পুরাটা। এর পরে আর লে-অফ করা যাবে না, শ্রমিক ছাঁটাই করে দিতে হবে (যদিও শ্রম আইনে আছে- মালিক ছাঁটাই 'করতে পারবেন')।
শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণের ধারাটি হচ্ছে- ধারা ২০।
১. কোনো শ্রমিককে প্রয়োজন অতিরিক্ততার কারণে কোনো প্রতিষ্ঠান হইতে ছাঁটাই করা যাইবে।
২. কোনো শ্রমিক যদি কোনো মালিকের অধীনে অবিচ্ছিন্নভাবে অন্যূন এক বৎসর চাকুরীতে নিয়োজিত থাকেন, তাহা হইলে তাহার ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে মালিককে- ক. তাহার ছাঁটাইয়ের কারণ উল্লেখ করিয়া এক মাসের লিখিত নোটিশ দিতে হইবে, অথবা নোটিশ মেয়াদের জন্য নোটিশের পরিবর্তে মজুরি প্রদান করিতে হইবে; খ. নোটিশের একটি কপি প্রধান পরিদর্শক অথবা তৎকর্তৃক নির্ধারিত কোনো কর্মকর্তার নিকট প্রেরণ করিতে হইবে এবং আরেকটি কপি প্রতিষ্ঠানের যৌথ দর কষাকষি প্রতিনিধিকে, যদি থাকে, দিতে হইবে; এবং গ. তাহাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ তাহার প্রত্যেক বৎসর চাকুরীর জন্য ত্রিশ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুয়িটি যদি প্রদেয় হয়, যাহা অধিক হইবে, প্রদান করিতে হইবে।
৩. উপধারা (২)-এ যাহা কিছুই থাকুক না কেন, ধারা ১৬(৭)-এর অধীন ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রে উপধারা (২) (ক)-এর উল্লিখিত কোনো নোটিশের প্রয়োজন হইবে না, তবে ছাঁটাইকৃত শ্রমিককে উপধারা (২) (গ) মোতাবেক প্রদেয় ক্ষতিপূরণ বা গ্র্যাচুয়িটির অতিরিক্ত হিসাবে আরো পনেরো দিনের মজুরি দিতে হইবে।
৪. যে ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ শ্রেণির শ্রমিককে ছাঁটাই করার প্রয়োজন হয় সে ক্ষেত্রে, মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে এতদসংক্রান্ত কোনো চুক্তির অবর্তমানে, মালিক ওই শ্রেণির শ্রমিকগণের মধ্যে সর্বশেষে নিযুক্ত শ্রমিককে ছাঁটাই করিবেন।
ছাঁটাইয়ের জন্য এক মাসের নোটিশ বা বেতন দিতে হবে, তার মানে- এক মাসের বেতন তো সবাই পাবেই। এ ছাড়া পাবে- শ্রমিকরা যে কয় বছর কাজ করেছে সে হিসাবে প্রত্যেক বছরের জন্য ৩০ দিনের মজুরি। তোবা গার্মেন্টের যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তাদের একটা বড় অংশকেই দেখেছি, চার বা পাঁচ বছর ধরে কাজ করেছে। চার বছর কাজ করলেও সে পাবে- পাঁচ মাসের বেতন (এক মাসের নোটিশ পিরিয়ড + চার মাস গ্রাচুইটি)। ১০ বছরের বেশি কাজ করলে (কেউ করেছে কি না জানা নেই)- সে ক্ষেত্রে গ্র্যাচুয়িটি কার্যকর হবে (১০ বছরের অধিক কর্মরত থাকলে গ্র্যাচুয়িটি প্রতিবছরের জন্য ৪৫ দিনের মজুরির সমান)। তবে এটা ঠিক, যারা তিন বছরের কম কাজ করেছে, তাদের জন্য ক্ষতিপূরণ চার মাসের মজুরির চেয়ে কম হয়ে যাবে এই শ্রম আইন অনুযায়ী। শুধু তাদের ক্ষেত্রে চার মাসের মজুরির দাবি তোলা যায়।
আরেকটি কথা বলা যায়- যেহেতু মালিক লে-অফ ঘোষণা না করেই কারখানা বন্ধ রাখছে, সেহেতু তারা কিন্তু আগস্ট মাসের বেতনও পুরো মাত্রায় পাবে (অর্ধেক নয়)। এবং যত দিন, লে-অফ ঘোষণা না করছে বা শ্রমিকদের ছাঁটাই করে কারখানা পুরো বন্ধ না করছে, তত দিন আইনত শ্রমিকরা পুরো মজুরি পাওয়ার অধিকার রাখে।
এ ক্ষেত্রে আরেকটি ধারা আছে- ধারা ২৬, যেখানে বরখাস্ত ইত্যাদি ব্যতীত 'অন্যভাবে' শ্রমিকের চাকরির অবসানে ক্ষতিপূরণ কী হবে, সে সম্পর্কে বলা হয়েছে।
ধারা ২৬-এ বলা হয়েছে, বরখাস্ত ইত্যাদি ব্যতীত অন্যভাবে মালিক কর্তৃক শ্রমিকের চাকরির অবসান-
১. এই অধ্যায়ের অন্যত্র বিধৃত কোনো পন্থা ছাড়াও মালিক-
(ক) মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকের ক্ষেত্রে ১২০ দিনের,
(খ) অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের, লিখিত নোটিশ প্রদান করিয়া কোনো স্থায়ী শ্রমিকের চাকুরীর অবসান করিতে পারিবেন।
২. এই অধ্যায়ের অন্যত্র বিধৃত কোনো পন্থা ছাড়াও মালিক-
(ক) মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৩০ দিনের,
(খ) অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের,
লিখিত নোটিশ প্রদান করিয়া কোনো অস্থায়ী শ্রমিকের চাকরির অবসান করিতে পারিবেন, যদি না এই অবসান যে অস্থায়ী কাজ সম্পাদনের জন্য শ্রমিককে নিযুক্ত করা হইয়াছে উহা সম্পূর্ণ হওয়া, বন্ধ হওয়া, বিলুপ্ত হওয়া বা পরিত্যক্ত হওয়ার কারণে হয়।
৩. যে ক্ষেত্রে মালিক বিনা নোটিশে কোনো শ্রমিকের চাকুরীর অবসান করিতে চাহেন সে ক্ষেত্রে, তিনি উপধারা (১) অথবা (২)-এর অধীন প্রদেয় নোটিশের পরিবর্তে নোটিশ মেয়াদের জন্য মজুরি প্রদান করিয়া ইহা করিতে পারিবেন।
৪. যে ক্ষেত্রে এই ধারার অধীন কোনো স্থায়ী শ্রমিকের চাকরির অবসান করা হয় সে ক্ষেত্রে মালিক-শ্রমিককে তাহার প্রত্যেক সম্পূর্ণ বৎসরের চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসাবে ৩০ দিনের মজুরি, অথবা গ্র্যাচুয়িটি, যদি প্রদেয় হয়, যাহা অধিক হইবে, প্রদান করিবেন এবং এই ক্ষতিপূরণ এই আইনের অধীন শ্রমিককে প্রদেয় অন্যান্য সুবিধার অতিরিক্ত হইবে।
Image result for কারখানা বন্ধএই ধারা অনুযায়ী স্থায়ী শ্রমিকের পাওয়ার কথা চার মাসের মজুরি + যে কয় বছর কর্মরত আছে, সে হিসেবে প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুয়িটি বা চার মাসের মজুরি- যেটি অধিক। যেহেতু তোবার কারখানা লে-অফ ঘোষণা ছাড়াই বন্ধ আছে, এ অবস্থায় হঠাৎ কারখানা বন্ধ করে দিলে- ২৬ নম্বর ধারার 'অন্যভাবে' শ্রমিকদের চাকরির অবসান বিবেচনায় নিলে এই ক্ষতিপূরণ শ্রমিকরা পেতে পারে।

logo

Post a Comment

0 Comments