শ্রম আইন কার জন্য? কেন? By ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট

আমার আইন পেশা-জীবন প্রায় ২২ বছরের। এর মধ্যে জাতিসঙ্ঘের একাধিক সংস্থায় আইন-পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছি এবং চারটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষকতাও করেছি (পূর্ণকালীন ও খণ্ডকালীন)।

তবে শ্রম আইন নিয়ে নিবিরভাবে কাজের সময়কাল বছর পাঁচেক। এর মধ্যে নানান অভিজ্ঞতা হয়েছে এবং হচ্ছে। তার ভিত্তিতেই এই লেখা।

মানব সম্পদ নিয়ে কাজ করেন এমন একটি পেশাদার-দলের সংগে সম্প্রতি এক মিটিংয়ে থাকার সুযোগ হয়েছে। বিভিন্ন আলোচনার ফাঁকে তাঁরা যা বললেন তার মর্মার্থ হ’ল- তাঁদের জন্য কোন আইন নেই! এই বিবৃতি কতটা সঠিক তা একটু পরেই আলোকপাত করবো।

শ্রম আইন নিয়ে আরও কিছু প্রচলিত ধারণা বিদ্যমান (আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে)। তা হ’ল-

• শ্রম আইন ‘শ্রমিকের” জন্য;
• শ্রম আইন শ্রম অধিকার নিয়ে, ইত্যাদি।

এই ধারণাগুলো সঠিক নয়। তা হলে কি?

আসুন প্রথমেই দেখা যাক বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (যা ২০১৩ সনে সংশোধিত)- এর উদ্দেশ্য কি?

শ্রম আইনের ভূমিকা অনুসারে উক্ত আইনের আওতাধীন বিষয়গুলো হ’ল নিম্নরুপ-
(১) শ্রমিক নিয়োগ, (২) মালিক ও শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্ক, (৩) সর্বনিম্ন মজুরীর হার নির্ধারণ, (৪) মজুরী পরিশোধ, (৫) কার্যকালে দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণ, (৬) ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, (৭) শিল্প-বিরোধ উত্থাপন ও নিষ্পত্তি, (৮) শ্রমিকের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, কল্যাণ ও চাকুরীর অবস্থা ও পরিবেশ, এবং (৯) শিক্ষাধীনতা।

আমার মতে, এখানে শ্রমিক (Labour) মানে যিনি শ্রম (Labour) দেন বা তাঁর শ্রম বিক্রি করেন, এবং তা পারিশ্রমিক বা মজুরীর বিনিময়ে।

শ্রম আইনের আওতা সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে (ব্যতিক্রম- আলাদা আইনের কারণে ইপিজেড এলাকা বাদে)।

কোন কোন প্রতিষ্ঠান শ্রম আইনের আওতায় তা দেখার আগে দেখে নেই আর কারা এই আইনের আওতার বাইরে।

যারা শ্রম আইনের আওতায় পড়বে না তা আইনের ধারা ১- এ বলা হয়েছে; শ্রম আইনের আওতামুক্ত যে যে প্রতিষ্ঠান তার মধ্যে রয়েছে- (ক) সরকার বা সরকারের অধিনস্ত কোন অফিস, (খ) সিকিরিটি প্রিন্টিং প্রেস, (গ) সমরাস্ত্র কারখানা, (ঘ) অসুস্থ, অক্ষম, বৃদ্ধ, দুঃস্থ, প্রতিবন্ধী, এতিম, পরিত্যক্তা মহিলা বা শিশু অথবা বিধবাদের চিকিৎসা, যত্ন বা সেবার জন্য পরিচালিত কিন্তু মুনাফা বা লাভের লক্ষ্যে পরিচালিত নয়, এরূপ কোন প্রতিষ্ঠান, (ঙ) প্রদর্শনীতে স্থাপিত এমন কোন দোকানপাট বা স্টল যাতে শুধু খুচরা বেচাকেনা চলে, (চ) প্রকাশ্য মেলায় বা বাজারে ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে স্থাপিত দোকানপাট বা স্টল, (ছ) মুনাফা বা লাভের জন্য পরিচালিত নয় এমন কোন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, (ঝ) মুনাফা বা লাভের জন্য পরিচালিত নয় এমন ছাত্রাবাস বা মেস, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ইত্যাদি।

সরকারের মালিকানাধীন এবং সরকার দ্বারা সরাসরি পরিচালিত কোন দোকান বা শিল্প বা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান যেখানে শ্রমিকরা সরকারী কর্মচারীদের জন্য প্রযোজ্য আচরণবিধি দ্বারা পরিচালিত হয় সেখানে শ্রম আইন প্রযোজ্য হবেনা।

তবে ব্যতিক্রম হ’ল- নিম্নোল্লিখিত প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রম আইনের দ্বাদশ অধ্যায় (দুর্ঘটনাজনিত কারণে জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ), ত্রয়োদশ অধ্যায় (ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প-সম্পর্ক) এবং চতুর্দশ অধ্যায় (বিরোধ নিষ্পত্তি, শ্রম আদালত, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল, আইনগত কার্যধারা, ইত্যাদি) প্রযোজ্য হবে-

(১ রেল বিভাগ;
(২) ডাক, তার ও টেলিফোন বিভাগ;
(৩) সড়ক ও জনপথ বিভাগ;
(৪) গণপূর্ত বিভাগ;
(৫) গনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ;
(৬) বাংলাদেশ সরকারী মুদ্রণালয়।

এর বাইরে সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে শ্রম আইন প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় নিয়োজিত সকল স্থান, কর্মশালা, কারখানা, প্রতিষ্ঠান, বীমা কোম্পানী, ব্যাংকসহ বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, খনি, চা বাগান, সংবাদপত্র, যান-বাহন, জাহাজ, নৌযান ইত্যাদি (শ্রম আইন, ধারা ২)।

এবার দেখা যাক শ্রম আইন কার জন্য? এটি শুধুমাত্র শ্রমিকের জন্য কোন আইন কি-না?

শ্রম আইন কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা স্থানের জন্য প্রযোজ্য তা উপরে বলা হয়েছে। আরেকটি বিষয় দ্রষ্টব্য।

আইনের নাম কিন্তু শ্রম আইন (Labour Act); শ্রমিক আইন (Workers’ Act) নয়।
শ্রম আইনের প্রধান পক্ষ হ’ল – মালিক এবং শ্রমিক। তাই এই আইন শুধুমাত্র শ্রমিকের জন্য নয়; বরং কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এই আইন প্রযোজ্য (প্রযোজ্যমত অন্যান্য আইনের পাশাপাশি)। যেমন- কোন কারখানা বা প্রতিষ্ঠান চালু করা থেকে বন্ধ করার বিষয়টি শ্রম আইনের বিধান দ্বারা পরিচালিত। এছাড়া কর্মরত শ্রমিকের নিয়োগ ও চাকরীর শর্তাবলী (শ্রম আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়), প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা (চতুর্থ অধ্যায়), প্রতিষ্ঠান ও কারখানায় স্বাস্থ্য রক্ষা ব্যবস্থা (পঞ্চম অধ্যায়), নিরাপত্তা (ষষ্ট অধ্যায়), স্বাস্থ্য বিধি ইত্যাদি (সপ্তম অধ্যায়), কল্যাণমূলক ব্যবস্থা (অষ্টম অধ্যায়), কর্মঘণ্টা ও ছুটি (নবম অধ্যায়), মজুরী ও তার দায় (দশম অধ্যায়), মজুরী বোর্ড (একাদশ অধ্যায়), দুর্ঘটনাজনিত কারণে জখমের জন্য ক্ষতিপূরণ (দ্বাদশ অধ্যায়), ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প-সম্পর্ক (ত্রয়োদশ অধ্যায়), বিরোধ নিষ্পত্তি, শ্রম আদালত, শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল, আইনগত কার্যধারা, ইত্যাদি (চতুর্দশ অধ্যায়), মুনাফায় অংশগ্রহণ (পঞ্চদশ অধ্যায়), ভবিষ্যৎ তহবিল (সপ্তদশ অধ্যায়), শিক্ষাধীনতা (অষ্টাদশ অধ্যায়), অপরাধ, দণ্ড ও পদ্ধতি (উনবিংশ অধ্যায়), (শ্রম) প্রশাসন, পরিদর্শন ইত্যাদি (বিংশ অধ্যায়) প্রভৃতি। তাই দেখা যাচ্ছে শ্রম আইনে অনেক বিষয় নিয়ে বিধান দিয়েছে।

শ্রম আইন একই সংগে যেমন শ্রমিকের অধিকারের বিধান দিয়েছে; যেমন- নিয়োগ ও চাকুরীর শর্তাবলী (দ্বিতীয় অধ্যায়); ট্রেড ইউনিয়ন ও দরকষাকষি করা (ত্রয়োদশ অধ্যায়) প্রভৃতি। অন্যদিকে তার (শ্রমিক) দায়-দায়িত্ব ও আইন পালনে ব্যর্থতায় এবং অসৎ শ্রম আচরণের জন্য শ্রমিকের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধানও দিয়েছে (ধারা ৩০০, ৩০১, ৩০২, ৩০৩, ৩০৪, ৩০৫, ৩০৭, ৩৩১; ১৯৫)।

একই সংগে শ্রম আইন মালিককেও (নিয়োগকারী হিসেবে) অধিকার অধিকার দিয়েছে। যেমন- তিনি প্রতিষ্ঠান বা কারখানা চালু করে কোন পণ্য বা সেবা উৎপাদন বা প্রদান করছেন, যার মাধ্যমে তিনি তাঁর স্বাধীন বৃত্তি বা পেশা বেছে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন; পাশাপাশি মুনাফা বা লাভ করতে পারছেন। এজন্য অবশ্য তাঁকে পুঁজি, মেধা প্রভৃতি বিনিয়োগ করতে হচ্ছে।

শ্রম আইনের যে সব ধারা মালিককে তাঁর অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিয়েছে সেগুলো হল- ১৩ (প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা), ২০ (শ্রমিক ও কর্মীকে ছাঁটাই), ২২ (ডিসচার্জ), ২৩ (অসদাচরনের শাস্তি), টার্মিনেশন (২৬), ১৭৬ (মালিকের সংগঠন করা), ১৯৬ (শ্রমিক দ্বারা অসৎ শ্রম আচরণ), ২০২ (যৌথ- দরকষাকষি), ২০৫ (অংশগ্রহণকারী কমিটি), ২০৯ (শিল্প-বিরোধ), ২১৩ (শ্রম আদালতে মামলা), ৩১৫ (অপরাধের রিপোর্ট) প্রভৃতি।
শ্রমিক কে?

শ্রম আইনে শ্রমিকের সংজ্ঞা [ধারা ২(৬৫)] দেয়া হয়েছে। যার মর্মার্থ হ’ল- তার চাকরীর শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য থাকতে পারে; সরাসরি বা ঠিকাদার-মাধ্যম আসতে পারেন; অর্থের বিমিনয়ে কাজ করেন- যা দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি (Technical), ব্যবসা উন্নয়নমূলক (Business Development), কেরানীগিরি ধরণের হতে পারে।

যারা প্রধানতঃ প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাঁরা শ্রমিকের সংজ্ঞার আওতার মধ্যে পড়বেন না।

তবে এই বিষয়ে কিছু বিষয় বিবেচ্য- আমাদের উচ্চ আদালত থেকে একাধিক মামলায় সিদ্ধান্ত আছে যে, পদবী বিবেচনায় নয়, বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাজের ধরণ দেখে নির্ধারণ হবে কে শ্রমিক, আর কে শ্রমিক নয়। এ নিয়ে মতান্তর হলে একমাত্র তথ্য ও ঘটনা বিবেচনা করে শ্রম আদালত সিদ্ধান্ত দিবেন।

আর শ্রম আইনের ধারা ৩ অনুসারে, কোন কারখানা, প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান প্রভৃতিতে নিয়োগ ও চাকরীর শর্ত সংক্রান্ত বিষয়ে শ্রম আইনের বিধান প্রাধান্য পাবে।
শ্রম আইনের (৩ ধারায়) বলা হয়েছে, যে সকল প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে (শ্রম আইন) প্রযোজ্য নয় সে সকল প্রতিষ্ঠানও উক্ত আইনের প্রদত্ত কোন সুযোগ-সুবিধার চেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে কোন নীতি, বিধি-বিধান, হাউজ-পলিসি করতে পারবে না।

তাই যারা দাবী করেন যে, কথিত মিড-লেভেল ম্যানেজারের (যারা মালিক ও প্রথাগত শ্রমিকের সংজ্ঞার বাইরে) জন্য কোন আইন নেই- তাঁদের এই বিবৃতি সঠিক নয়। আইন আছে তবে তাতে কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে।

শ্রম আইন কিছু ক্ষেত্রে (যেমন- কর্মে নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলী, কল্যাণ সুবিধা, স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা, নিরাপত্তা, কল্যাণমূলক ব্যবস্থা, কর্মঘণ্টা ও ছুটি, মুজুরি নির্ধারণ ও তা পরিশোধ প্রভৃতি বিষয়ে) শ্রমিকদের বিষয়ে যত স্পষ্টভাবে বিধান দিয়েছে, যারা শ্রমিক সংজ্ঞার বাইরে পড়বে অথচ একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সে বিষয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। পরবর্তী আইন সংশোধনকালে তা সংশোধন করা দরকার।

তাঁরা যেহেতু কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাই তাঁদের নিয়োগ এবং চাকরী শর্তাবলী শ্রম আইনের আলোকে হতে হবে। কর্মরত ব্যক্তিদের চাকরী ও নিয়োগ-সংক্রান্ত নিজস্ব বিধি-বিধান করার ক্ষেত্রেও শ্রম আইনের শর্ত অনুসারে তা করতে হবে। এই শ্রম আইনে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুযোগ সীমিত। আর কর্মীর ক্ষতিপূরণ এবং সুযোগ-সুবিধার দায় এড়ানোর জন্য তাকে কথিত চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিলে (যেখানে বছরের পর বছর কাজ করেছেন) আইনের দৃষ্টিতে তা গ্রহণযোগ্য নয়। আমার আরেক লেখায় এই বিষয়ে সবিস্তার আলোচনা করেছি।

তবে হ্যাঁ, যুগের প্রয়োজনে কথিত মিড-লেভেল ম্যানেজারসহ যারা বুদ্ধিবৃত্তিক শ্রমে নিয়োজিত তাঁদের চাকরীর শর্তাবলীসহ অন্যান্য বিষয় দেখার জন্য আলাদা আইন করা যেতে পারে। তা যতদিন না হয় প্রচলিত শ্রম আইন দিয়েই তার সমাধান সম্ভব। তবে তার জন্য শ্রম আইনের কিছু ধারায় কিছু পরিবর্তন আনলে ভাল হয়।

(মতামত লেখকের নিজস্ব, এর সঙ্গে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই)।
দ্রষ্টব্য: এই লেখা শিক্ষামূলক উদ্দেশ্যে তৈরি। আপনার সমস্যার জন্য সংশ্লিষ্ট আইন দেখুন এবং এই বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীর সংগে পরামর্শ করুন।
 

আপনার আরও কোন প্রশ্ন থাকলে যোগাযোগ করতে পারেন-


ড. উত্তম কুমার দাস, এডভোকেট
সুপ্রীম কোর্ট অব বাংলাদেশ
ই-মেইলঃ ukdas1971@gmail.com
ফোনঃ ০১৭৫৬ ৮৬৬৮১০।

Post a Comment

0 Comments