যেভাবে চলছে আমাদের কর্পোরেট জীবন

 


কেউ যদি কর্পোরেট সেক্টরে চাকুরীরত কোন ব্যক্তির কাছে প্রশ্ন করেন যে তার কাজের সময় কত ঘন্টা কিংবা পরিবারকে তিনি কতটুকু সময় দিতে পারেন, অথবা তার একান্ত নিজের সময় কতটুকু? তবে জেনে রাখবেন এই ধরণের কোন প্রশ্ন করার অর্থ হল তার হৃদয়ে একটি তীর বিঁধিয়ে দেয়া। একজন কর্পোরেট দাসের কর্মজীবনে অনেক কিছুই থাকে অঘোষিত, কিছু ঘোষিত আবার কিছু স্বঘোষিত। কর্মঘন্টা নিয়ে বাস্তব কিছু উদাহরণ তুলে ধরলাম।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সন্তুষ্টি এবং দীর্ঘ সময় অফিস- কিছু অফিস আছে যেখানে এমপ্লয়ীরা কোন কাজ না থাকলেও কেবল “ঊর্ধ্বতন স্যার” কে খুশি করার জন্য ৬টার পরও ১-২ ঘন্টা অফিসে বসে থাকেন। কেউ আবার কাজের গতি কমিয়ে দেন, ভাবেন স্যারতো আটটার আগে বের হবেন না, সুতরাং বসে বসে “মাথা” আর “মাউস” নাড়াই! এই অতি উতসাহী করমীরাই বঞ্চিত করছেন নিজেকে, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে একটু অবকাশ কিংবা বিনোদন থেকে। তারাই বঞ্চিত করছেন আপন পরিবার পরিজন সন্তানদেরকে, যারা দিনের শেষে তাদের অপেক্ষায় প্রহর কাটায়- কখন তারা ঘরে ফিরবেন সেই অপেক্ষায়।

অসময়ে অফিসের লাইট, ফ্যান, এসি চালিয়ে বিদ্যুতের বিল বাড়াচ্ছেন এই ব্যক্তিরাই। আর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (স্যার) ভাবছেন- বাহ! আমার অফিসাররা তো বেশ কাজের। যিনি যত দেরীতে অফিস ত্যাগ করবেন তিনি যেন তত বেশী নিবেদিত কর্মী, যিনি ৬টার পরপরই চলে যাবেন তিনি রোষানলে পড়বেন। আবার বড় স্যারের উপরের কর্তারা ভাবছেন- বেশ বেশ! অমুক ম্যানেজারের পারফর্মেন্স ট বেশ ভাল, রাত আটটা নয়টা পর্যন্ত কাজ করছে এবং করাচ্ছে! কিন্তু বিষয়টা কি এভাবে ভাবা যায় না যে অফিস টাইমের পর অযথা ২/৩ ঘন্টা অফিসে বসে যে বিদ্যুৎ এর অপচয় হচ্ছে তার প্রতিকার হওয়া দরকার। মাঝে মাঝে দু-চারজন কর্মকর্তা কর্মচারীদেরকে গদগদ কন্ঠে বলতেও শুনেছি, দেখেছেন প্রতিষ্ঠানের জন্য আমরা জীবন যৌবন উৎসর্গ করে দিয়েছি! আহা!

কিন্তু তারা জানেনা তারা কত বড় ভুল ধারণা পোষণ করছে। তারা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন সেখানে অবশ্যই কাজের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সবকিছু করবেন কিন্তু জীবন উৎসর্গ করে কেন? তাহলে কি কোন পারিবারিক জীবন নেই তাদের! তাই বলি ভাই, কাজকে ভালোবাসুন তবে কোম্পানীকে নয়। কেননা আপনি জানেন না ঠিক কখন কোম্পানী আপনাকে আর ভালোবাসবে না।

দু’ এক দিন অফিসে বাড়তি কাজ থাকতেই পারে, একটু দেরী হতেই পারে। তাই বলে প্রতিদিন ৮টা -১০ টা পর্যন্ত আপনি কেন অফিস করবেন? আর কোনদিন মিটিং থাকলে তো কথাই নেই, কখন সেটা শেষ হবে কেউ জানে না! রাত ৭/৮টায় মিটিং শুরু করা যেন বর্তমানে সাংবিধানিক নিয়ম হয়ে যাচ্ছে। আমি অনেকের কাছ থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মিটিং এর কথাও শুনেছি। আমার মনে হয় না সারাদিন কঠোর পরিশ্রমের পর এতো রাতে মিটিং করলে সেই মিটিং কোন সুফল বয়ে আনতে পারে। ছাত্রজীবনে আমাদের পরীক্ষার সময় ৩ ঘন্টা বেঁধে দিয়েছিল কেন জানেন? কর্মজীবনে যাতে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারি। এখন দেখছি আমরা নিজেরাই সময়ের প্রতি সবচাইতে বেশী উদাসীন। অফিসের ভেতরে ছাড়া বাইরেও যে একটা জীবন আছে সেটা অনেকে ভাবতেই পারেন না।

আপনি যদি একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা “স্যার” হয়ে থাকেন তাহলে প্লিজ একবার হিসাব কষে দেখবেন কি- জীবনে “কত জন” এমপ্লয়ীর , “কত দিনে”, “কত ঘন্টা” সময় আপনি এভাবে শেষ করে দিয়েছেন! আর “লেট অফিসার” গণও একটু হিসাব করে দেখবেন জীবেন কতঘন্টা সময় অনর্থক অফিসে বসে বসে শেষ করেছেন এবং ভবিষ্যতে করবেন। সর্বশেষ দুই জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা “স্যারের” উদাহরণ দিচ্ছি- কর্পোরেট এমপ্লয়ীর জীবন থেকে সংগৃহীত-

দৃশ্যপট ১ - “সোয়া ছয়টায় সব কাজ শেষ, তবু দেড় ঘন্টা বসে থেকে উনার চেম্বারে সালাম দিয়ে বিদায় নিতে গেলাম। উনি একটু অবাক, কিছুটা হতাশ গলায় বললেন- এখনই চলে যাবেন? তারপর টানা ৩৫ মিনিট দাঁড় করিয়ে রেখে “বসের সন্তুষ্টি ও চাকুরীর উজ্জল ভবিষ্যৎ” বিষয়ে বিরক্তিকর মহামূল্যবান ওয়াজ শোনালেন। কর্পোরেট এমপ্লয়ীর জীবন থেকে সংগৃহীত-

দৃশ্যপট ২- “নতুন জয়েন করার দুদিন পর তিনি সবাইকে ডেকে বললেন- যার যার ডেক্সের কাজ শেষ করেই অফিস ত্যাগ করবেন। আমার অনুমতির জন্য বসে থাকবেন না। ২/১ টা ডেক্স ছাড়া ৬টার পরও যারা অফিসে বসে থাকে আমার কাছে তারা অদক্ষ কিংবা রোগী। পরদিন থেকেই সন্ধ্যা ৬টার পর অফিস অন্ধকার! বস তো অবাক! পরদিন সকাল সকাল অফিসে এসেই পুনরায় সবাইকে অফিসে ডাকলেন। সবার কাজের মান যাচাই ও হিসাব নিলেন। দেখলেন বিগত দিনের চাইতে সবার কাজের দক্ষতা অনেকগুন বেড়ে গেছে। তাই আমার কাছে মনে হয় সবাইকে অফিসের নিদিষ্ট সময়ের মধ্যেই কাজ শেষ করে নিদিষ্ট সময়েই অফিস ত্যাগ করতে হবে এমন নিয়ম করে দিলে কাজের মান অনেকগুন বাড়বে।

আমার এই লেখাটি কোন প্রাতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য নয়। শুধু কাজের সুষম বন্টন ও সঠিক সময়ে সঠিক কাজকে উৎসাহিত করার একটি প্রয়াস। তবে আমার বিশ্বাস যদি ঊর্ধ্বতন স্যারেরা সর্বদা সঠিক সময়ে অফিসে উপস্থিত হওয়া এবং সঠিক সময়ে অফিস থেকে পরিত্যাগের বিষয়টি নিয়ে একটু ভাবেন এবং উদ্যেগ গ্রহন করেন তাহলে অতিদ্রুত তা বাস্তবায়ন সম্ভব।

 

মোঃ সোহেল রানা প্রতিষ্ঠাতা সদস্য- এইচআর এন্ড কম্প্লায়েন্স সোসাইটি অব বাংলাদেশ

Post a Comment

0 Comments