চাকুরী থেকে ছাঁটাই ও বরখাস্ত: কি বলা আছে শ্রম আইনে? By শাহনাজ পারভীন

বাংলাদেশে পোশাক খাতে গত দুই মাসে অন্তত সাড়ে সাত হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে বলে দাবি করছে ট্রেড ইউনিয়নগুলো। 

বাংলাদেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে চাকুরী হারানো কোন ব্যাপারই নয়, এমন একটি অভিযোগ রয়েছে।  

বলা হয় সামান্য একটু দোষে অথবা মালিকের পছন্দ অপছন্দের কারণে আপনার জীবিকা নাই হয়ে যেতে পারে।

কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী হিসেবেও নানা কারণে আপনি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে পারেন।

জেনে নিন শ্রমিক ও কর্মীদের চাকুরিচ্যুত করা প্রসঙ্গে কি বলা আছে বাংলাদেশের আইনে, বাস্তবতা কি আর বিচারে কোথায় যাবেন।

বরখাস্ত, ছাঁটাই, চাকুরীর অবসান

শ্রম আদালতের বার এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট একেএম নাসিম বলছিলেন পৃথিবীর সব দেশেই ছাঁটাই, বরখাস্ত, চাকুরিচ্যুতি সম্পর্কে নানা ধরনের নিয়ম আছে। বাংলাদেশে এই সবগুলোর আলাদা ব্যাখ্যা আছে।

বাংলাদেশে শ্রম আইন ২০০৬-এর চ্যাপ্টার দুইতে এ সম্পর্কিত পদক্ষেপ নিয়ে আলাদা আলাদা নিয়মের উল্লেখ রয়েছে। এর সবগুলোর মধ্যে রয়েছে সূক্ষ্ম তফাৎ।

অ্যাডভোকেট নাসিম বলছেন, "চাকুরী হারানোর সবচাইতে বড় শাস্তি ধরা হয় বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টিকে। কোন শ্রমিক যদি কোন ধরনের অন্যায়, অপরাধ, অসদাচরণ করে তাহলে এটা করা হয়ে থাকে। সে অন্যায় নানা রকম হতে পারে।"

"আরেকটি হল টার্মিনেশান বা চাকুরীর অবসান। সেটি হল কোনও মালিকের আপনাকে পছন্দ হচ্ছে না কিন্তু সে আপনাকে বরখাস্ত করার কোন কারণ দিতে পারছে না। সেটিকে বলা হয় টার্মিনেশান।"

ছাঁটাই সম্পর্কে অ্যাডভোকেট নাসিম ব্যাখ্যা করে বলছিলেন, "ছাঁটাই হল যেমন ধরুন কোন মালিকের একশ জন শ্রমিক আছে। তিনি যদি মনে করছেন তার একশ জন শ্রমিকের মধ্যে দশজনকে দরকার নেই। অথবা তিনি তাদের বেতন দিয়ে কর্মী হিসেবে রাখার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছেন। তাহলে তিনি সবচাইতে পরের দিকে নিয়োগ দেয়া দশজন কর্মীকে ছাঁটাই করতে পারেন। এটিকে বলে রিডানডেনসি"

প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সুরক্ষা কম?

অ্যাডভোকেট নাসিম বলছেন শ্রমিক কারা হবেন আর কর্মী কারা হবেন তারও ব্যাখ্যা দেয়া আছে।

কাজের ধরনের উপর নির্ভর করে শ্রমিক ও কর্মী নির্ধারিত হয়।

কর্মীরা সাধারণত প্রাতিষ্ঠানিক খাতে অফিস আদালতে কাজ করেন বলে মনে করা হয়।

তবে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয়েও শ্রমিক থাকতে পারেন। শ্রম আইন শুধু শ্রমিকদের ক্ষেত্রেই কাজে আসবে।

তিনি বলছেন, চাকুরী হারানোর ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের যারা কর্মী তাদের সুরক্ষা সবচাইতে কম।

চাকুরীতে নিয়োগের সময় চাকুরী-দাতার সাথে চুক্তিতে কতটা দর-কষাকষি আপনি করতে পেরেছেন তার উপর নির্ভর করবে চাকুরী চলে গেলে আপনি কতটা সুবিধা পাবেন বা চাকুরী যাওয়ার ক্ষেত্রে নিয়মকানুন গুলো কি হবে।

সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নানা অফিসে নিয়ম আলাদা।

মি. মোল্লা বলছেন, বাংলাদেশে এমন কর্মীদের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন আইন করা হয়নি।

তাদের সুরক্ষাও কম। সাংবাদিকদের জন্য আলাদা কিছু নিয়ম আছে।

তবে বিশ্বব্যাপী একটি নিয়ম হল এক মাসের নোটিশ দিতে। সেটি মানেন প্রায় সবাই।

বরখাস্ত, ছাঁটাই, চাকুরীর অবসানের ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মী কি ধরনের আর্থিক সুবিধা পাবেন সেটিও নির্ভর করে চাকুরী-দাতার সাথে চুক্তির উপর।

এই ব্যাপারেও বাংলাদেশে নির্দিষ্ট কোন আইন নেই।

চাকুরী হারানো শ্রমিকের যেসব সুবিধা প্রাপ্য

আইনে শ্রমিকদের জন্যেও বলা রয়েছে অনেক কিছু। ছাঁটাই হলে শ্রমিককে এক মাস আগে জানাতে হবে।

ঐ প্রতিষ্ঠানে প্রতি এক বছর চাকুরীর জন্য এক মাসের বেসিক বেতন পাবেন শ্রমিক।

যেমন দশ বছর চাকুরী করলে সে দশ মাসের বেসিক বেতন পাবে। ক্ষেত্র বিশেষে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিক ক্ষতিপূরণও পেতে পারেন।

তবে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক কোন ধরনের বেতন ভাতা ছাড়াই চাকুরী হারাবেন।

কিন্তু তাকে বরখাস্তের আগে কারণ দর্শাও নোটিস করতে হবে, অন্যায়ের অভিযোগ তদন্ত করতে হবে, তদন্তে শুধু মালিকের পছন্দের ব্যক্তি নয় শ্রমিক পক্ষের ব্যক্তিও থাকতে হবে।

সেই সাথে শ্রমিককে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। এরপর যদি সে দোষী সাব্যস্ত হয় তবেই তাকে বরখাস্ত করা যাবে।

চাকুরীর অবসান বা টার্মিনেশান হলে শ্রমিককে অন্তত চার মাস আগে জানাতে হবে।

অথবা মালিক কোন নোটিশ ছাড়াই যদি তাকে চলে যেতে বলেন তাহলে তাকে চারমাসের বেতন দিতে হবে।

বাস্তবতা কেমন?

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব লেবার স্টাডিজের পরামর্শক আবু ইউসুফ মোল্লা বলছেন, "যেমন পোশাক খাতে বরখাস্ত না করে ছাঁটাই করা হয় বেশি। টার্মিনেশান ক্লজটাও তারা ব্যবহার করেন। তবে ছাঁটাই করার প্রবণতাই বেশি। এতে কম বেনিফিট দিতে হয়। আবার শ্রমিক এটিকে আইনত কোন চ্যালেঞ্জ করতে পারে না। আর এসব তারা আইনজীবীদের পরামর্শেই করে থাকেন।"

তিনি বলছেন, যেসব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপত্রের বালাই নেই সেখানে মৌখিক কথাতেই চাকুরিচ্যুতি হয়।

প্রাতিষ্ঠানিক খাতে সকল প্রতিষ্ঠানই আইনি বিষয়ে পরামর্শক নিয়োগ করে থাকে।

মি. মোল্লা বলছেন, "পোশাক খাতে আজকাল তারা বরখাস্ত করার দরকার পরলে তদন্ত করে। আগের মতো এক পাক্ষিক তদন্তও হয়না। কমপ্লায়ান্সের কারণে তাদের এটা করতে হয়।"

অন্যায় হলে কোথায় যাবেন?

বাংলাদেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে সাতটি শ্রম আদালত রয়েছে।

আপনি যদি মনে করেন আপনার সাথে অন্যায় হয়েছে তাহলে সেখানে আপনি মামলা করতে পারেন।

তবে বাংলাদেশে এই আদালতগুলোতে অভিযোগ মীমাংসা হতে এতটাই সময় লাগে এবং যে পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হয় তাতে শ্রমিক পর্যায়ের একজন ব্যক্তি সেখানে যাননা।

অথবা তারা এমন আদালত বিষয়ে কিছু জানেনই না। তবে শ্রমিকদের আইনি সহায়তা দেয়ার জন্য সরকারি একটি সেল রয়েছে।

কিন্তু তার কার্যক্রম বাস্তবে খুবই সীমিত।

আর প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মী পর্যায়ে যারা আছেন তাদের জন্য বিচার পাওয়ার সুযোগ বাংলাদেশে সীমিত।

 

Post a Comment

0 Comments