নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে আইনী লড়াই: যা জানা দরকার

যারা চাকরী করেন তাদের পেশাজীবনের কোন না কোন পর্যায়ে খারাপ পরিস্থিতি বা কর্ম-পরিবেশের শিকার হয়েছেন। আর তা ঘটতে পারে সংশ্লিষ্ট অফিসের “অভ্যন্তরীণ-রাজনীতি”, কর্মীর নিজের কাজের চাপ কিংবা অন্য কোন কারণে মানসিক চাপ অথবা তাঁর অধিকারের গুরুতর লংঘনের কারণে। এমন পরিস্থিতি হলে অনেকেই নতুন করে চাকরী খোঁজেন; আর অন্যরা যারা তাঁদের নিয়োগকারীকে (শ্রম আইনে যাকে মালিক বলা হয়েছে) আইনীভাবে মোকাবেলা করতে চান এবং তা করার মতো যাঁদের আগ্রহ ও রসদ থাকে তাঁরা তাঁদের অধিকার আদায়ে নামেন।

তবে এটা ঠিক কোন নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে নামা সব সময় সহজ কাজ নয় নয়। কারণ তিনি একটি প্রতিষ্ঠান-সংশ্লিষ্ট যার অবস্থানগতভাবে বেশী সম্পদ ও সুবিধা রয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বে-আইনী কাজ বা পদক্ষেপের শিকার হয়ে আপনি পিছু হটবেন বা চুপ করে থাকবেন। আমাদের দেশেও বেশ কিছু আইন রয়েছে যার লক্ষ্য হল শ্রমিক বা কর্মীকে সুরক্ষা দেওয়া এবং অধিকার লঙ্ঘন হলে তার প্রতিকার। এতে আইন লংঘনকারীর শাস্তির (জেল ও জরিমান) ব্যবস্থা রয়েছে (যেমন- বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬)।

আপনি কি করবেন?
আপনি যদি কোন প্রতিষ্ঠান বা কারখানায় চাকরী করে থাকেন (বা আগে করতেন) তা হলে আপনার প্রথম বিবেচ্য হবে আপনার দাবী বা অভিযোগের বিষয়বস্তু কি তা সঠিকভাবে বুঝতে পারা; কোন প্রেক্ষিতে বা কিসের ভিত্তিতে আপনি মনে করছেন যে আপনার অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে।

একটি উদাহরণ দেওয়া যাক- আপনার বস আপনাকে একবার অপদস্ত বা অপমান করলে তা মানসিক হয়রানির পর্যায়ে নাও পড়তে পারে। তবে ক্রমাগত অপদস্ত হওয়ার প্রেক্ষিতে যদি আপনার কোন মানসিক সমস্যা হয় তাহলে আপনি ক্ষতিপূরণ দাবী করে আইনী প্রতিকারে যেতে পারেন। এমনকি ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারেন।

আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে আপনাকে দেখতে হবে আপনি কোথায় কাজ করেন কিংবা করেছেন। সরকারী অফিস বা প্রতিষ্ঠানে কাজ করলে আপনার জন্য সরকারী চাকরী সংক্রান্তবিধিমালা প্রযোজ্য হবে। আর বেসরকারী কর্মস্থল (ব্যাংক, বীমা ইত্যাদিসহ) হলে বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (২০১৩ সনে সংশোধনীসহ) এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ প্রযোজ্য হবে।

এছাড়াও আরও কিছু মৌলিক ও বিধিবদ্ধ আইন, যেমন- সংবিধান, চুক্তি আইন এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনের প্রযোজ্যতাআসবে। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের ঘটনা হলে এই বিষয়ে মাননীয় হাই কোর্ট বিভাগ থেকে জারী করা নীতিমালা, এমনকি নারী (ও শিশু) নির্যাতন সংক্রান্ত প্রচলিত আইনও প্রযোজ্য হতে পারে।

আরেকটিদেখার বিষয়- আপনি যেখানে কাজ করেন তার নিয়োগকর্তা আপনাকে কি ধরণের কাজ করার জন্য নিয়োগ দিয়েছেন, তার বদলে আপনার প্রাপ্য কি কি- তা আর্থিক বা অন্য কোন সুবিধা হতে পারে, আপনার ক্ষমতা ও দায় কতটা। তা আপনার নিয়োগপত্র বা চুক্তিপত্রের শর্ত অনুযায়ী দেখতে হবে। তবে এসব শর্ত মৌলিক অধিকারের নীতিমালা,  প্রচলিত কোন আইনের পরিপন্থী হলে তাও আপনি চ্যালেঞ্জ করতে পারেন।

আরেকটি দেখার বিষয়- বে-আইনীভাবে আপনার চাকরীর অবসান হয়েছে কি না; তা ছাঁটাই, প্রয়োজনীয় নোটিশ-সময় ছাড়া টার্মিনেশন, বা আইনানুগ প্রক্রিয়া না মেনে বরখাস্ত প্রভৃতির যে কোনটি হতে পারে।

আপনার দায়িত্ব
অপরদিকে,আপনাকে নিজ অধিকারের পাশাপাশি দায়িত্ব সম্পর্কেও সজাগ হতে হবে। আপানার কর্ম-ঘণ্টা, নির্ধারিত কাজ প্রভৃতি জেনে নিবেন। পদত্যাগের নোটিশ দিতে হলে তা কত দিন লাগবে, ছুটি ইত্যাদি ভাল করে জানবেন। এজন্য আপনার নিয়োগপত্র কিংবা চুক্তিপত্র ভাল করে পড়তে ও বুঝতে হবে। বিশেষত: তার শর্তাবলী, আপনার অফিসের চাকরী বিধিমালা, সার্কুলার প্রভৃতি।

সমস্যা হলে কি করবেন? 
এই ক্ষেত্রে প্রথম কাজ হবে অফিস বা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক বা মানবসম্পদ কর্মকর্তার কাছে যাওয়া; আর তা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সংগে আলোচনা করা। এতে আপনি কি কারণে ও কিভাবে বঞ্চিত বা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন তা আইনের আলোকে তুলে ধরবেন। প্রয়োজনে লিখিতভাবে জানাবেন এবং কি প্রতিকার চাচ্ছেন তাও প্রস্তাব করতে পারেন। লিখিত দিলে তার প্রমাণ (প্রাপ্তি স্বীকারপত্র) রাখবেন। 

আগের ধাপে কাজ না হলে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুযোগ দিতে পারেন। তা হ’ল নিয়োগকারীকে আপনার দাবী বা অভিযোগ সরাসরি আপনার পক্ষ থেকে জানানো। শ্রম আইন অনুযায়ী, তা লিখিতভাবে করতে হবে এবং ক্ষুব্ধতার বিষয় উদ্ভব হওয়ার ৩০ দিনের মধ্যেই জানাতে হবে। এতে প্রতিকার না হলে পরে আদালতে যেতে পারেন।

আগেই বলেছি, আপনার কর্মস্থল ও নিয়োগের ধরণ প্রভৃতি বিবেচনা করে আগাতে হবে।শ্রম আইনের আওতায় মজুরী ও পাওনাদি আদায় প্রভৃতির জন্য কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহায়তা নিতে পারেন। আর শিল্প-বিরোধ (ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত অধিকার) হলে যেতে হবে শ্রম পরিদপ্তরে। অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনেও অভিযোগ করার সুযোগ রয়েছে।

আইনী সহায়তা (বিনা খরচে) দরকার হলে এই ক্ষেত্রে কাজ করছে সরকারের আইন সহায়তা সংস্থা; তাতে যেতে পারেন। এর অফিস প্রতিটি জেলা আদালত সংলগ্ন। ঢাকায় শ্রম আদালত ভবনেও এর অফিস রয়েছে। এছাড়া বেসরকারী সংস্থা বাংলাদেশ লিগাল এইড এন্ড সার্ভিসেস ট্রাষ্ট (ব্লাস্ট)-এর সয়ায়তাও নিতে পারেন। অনেক আইনজীবী বিনা খরচে আইনী পরামর্শ দেন। তাঁদের কাছেও যেতে পারেন।

আরও কিছু কথা
যদি আপনি আপনার নিয়োগকারীর বিরুদ্ধে আইনী লড়াইয়ে যান তা হলে মনে রাখবেন আপনাকে যথাযথভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে। আপনি যে কারণ বা যে ঘটনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বা যার ফলে আপনার অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে তার রেকর্ড রাখুন। এতে তারিখ ও সময়সহ বিস্তারিত নোট করুন। প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রের কপি জোগাড় করুন। আপনাকে যে আইনজীবী (অবশ্যই চাকরী ও শ্রম-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ ও অভিজ্ঞ) আপনাকে পরামর্শ দিবেন এতে তাঁর সুবিধা হবে। 
আর চাকরীতে ঠোকার শুরু থেকেই সকল প্রাসঙ্গিক কাগজপত্রের কপি; যেমন- নিয়োগ বা চুক্তিপত্র, পরিচয়পত্র, প্রমোশন বা বদলীর কাগজ, আপানার কাজ বা অন্য বিষয় সংশ্লিষ্ট এমন কোন নোটিশ, সার্কুলার(ই-মেইলসহ) সব সংগ্রহে রাখুন। এর একাধিক সেট করে অফিস, বাসা এবং আরও কোথাও রাখুন। ই-কপি করেও ই-মেইলে/ড্রাইভে রাখতে পারেন। পরে কাজ লাগতে পারে।
(মতামত লেখকের নিজস্ব, এর সংগে প্রাতিষ্ঠানিক সংশ্লিষ্টতার কোন সম্পর্ক নেই।)

লেখক : আইনজীবী ও মানবসম্পদ বিষয়ক পরামর্শক। 
ই-মেইল: ukdas1971@gmail.com, ফোন:০১৭৫৬৮৬৬৮১০।

ঘোষণা:

শ্রম আইনের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ এবং বিভিন্ন বিষয়- যেমন চাকরী সংক্রান্ত বিষয়াবলী, চাকরীর অবসান ও পাওনাদি, মজুরী ও সুবিধাধি, শাস্তিমূলক ব্যবস্থা, শিল্প-সম্পর্ক প্রভৃতির উপর প্রশিক্ষণের জন্য যোগাযোগ করতে পারেন। আমাদের এই সেবা পেশাগত ও সামাজিক দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে পরিচালিত এবং বিনা খরচে (Pro-bono services)।
যোগাযোগ: The Lawyers, ফোন: ০১৭৭৪ ০৪৪৬১০; ই-মেইল:thelawyersbd@gmail.com

Post a Comment

0 Comments