অবহেলীত শ্রমিক সমাজ, মে দিবস ও আমাদের শ্রম আইন

কলকারখানার চাকা ঘুরলেই উৎপাদন হয়। উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণী। যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিক শ্রেণীর অবদান অপরিসীম। কিন্তু সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ শ্রমিক শ্রেণী অবহেলিত, বঞ্চিত। ন্যায্য পাওনা আর কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য অগণিত শ্রমিক রাজপথে জীবন উৎসর্গ করেছেন। রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় ঘটনা লেখা আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।
এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৩০ বছর আগে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকদের মানবিক শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ হয়েছিল। ১৮৮৯ সাল থেকে ১ মে শ্রমিক সংহতির ও শ্রেণী-সংগ্রামের প্রতীকী দিবস হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও ১ মে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ শ্রমিক প্রতিনিয়ত তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে।
শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ক, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে প্রণীত হয়েছে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’।
প্রায়ই খবরের কাগজে ফ্যাক্টরিতে কিংবা দোকানে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। অনেক সময় মালিক পক্ষের গাফিলতির কারণে এরকম বড় বড় দূর্ঘটনা ঘটে থাকে বলে জানা যায়। দূর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে কখনও কখনও ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটি আগুনের জন্য বেশিরভাগ মালিকপক্ষকে দোষারোপ করেন। মালিকপক্ষ অগ্নিকা-ের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এছাড়া আহত শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং নিহতদের সাধ্যমত ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন। অপরদিকে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আহত ও নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য বিভিন্ন দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরেন। গার্মেন্টস বা ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। এর আগেও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। নিঃস্ব হয়েছে অনেক পরিবার। অধিকাংশ দূর্ঘটনাই মালিক পক্ষের অসাবধানতার কারণে হয়ে থাকে। অল্প বেতনে চাকরি করা এসব শ্রমিকদের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করা হয় না। মালিকপক্ষের সামান্য অবহেলা বা গাফিলতির কারণে অনেক পরিবার সর্বহারা হয়ে থাকে। মা হারায় তার প্রিয় সন্তানকে, স্ত্রী হারায় তার স্বামীকে, সন্তান হারায় তার প্রিয় বাবাকে।
গার্মেন্ট শিল্প বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করেছে। এ শিল্প আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের ৭৬ শতাংশ অর্জন করে। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে অনেক অর্থনৈতিক কার্যক্রম সম্প্রসারিত হচ্ছে। গার্মেন্ট শিল্পে প্রায় ৯০ শতাংশ মহিলা শ্রমিক কাজ করে। এতে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ছে। সিপিডির হিসাব অনুযায়ী মোট জাতীয় উৎপাদনে এ খাতের অবদান প্রায় ৯ শতাংশ। কিন্তু এ খাতে শ্রমিকদের সর্বাধিক অবদান থাকলেও তারা তাদের ন্যূনতম আইনগত অধিকারসহ মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যথাযথ মজুরি না দেওয়া, বাসস্থান, পরিবহন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকা, সাপ্তাহিক ছুটি না দেওয়া, বাধ্যতামূলক অতিরিক্ত সময় কাজ করানো, মাতৃত্বকালীন ছুটি না দেওয়া গার্মেন্ট শিল্পের নিয়মিত সমস্যা। আইনে থাকলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কোনো শিশুপরিচর্যা কেন্দ্রের ব্যবস্থা না থাকা, আগুন লাগাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থার পর্যাপ্ত অভাব, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকাও গার্মেন্ট শ্রমিকদের বড় সমস্যা।

আইনে একজন শ্রমিকের অধিকারঃ
শ্রমিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীনসহ কোনো ব্যক্তি, তার চাকরির শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি বা ঠিকাদারের মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনো দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি, ব্যবসায় উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন। কিন্তু প্রধানত, প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। ‘শ্রম আইন-২০০৬-এর অধীনে একজন শ্রমিক কোনো মালিকের কারখানায় শ্রমিক হিসেব চাকরিতে নিযুক্ত হলে এ আইনের ৫ ধারায় নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র পাওয়ার অধিকারী। চাকরিকালীন সময় একজন শ্রমিক ১০৩ ধারা অনুসারে প্রতিষ্ঠান ভেদে একদিন, দেড়দিন, ২৪ ঘণ্টা সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে পারবেন। ওইরূপ ছুটির জন্য তার মজুরি থেকে কোনরুপ কর্তন করা যাবে না। শ্রম আইনের ১১৫ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকা বছরে পূর্ণ মজুরিতে দশদিনের নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার অধিকারী হবেন। ১১৬ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি এক বছরে পূর্ণ মজুরিতে ১৪ দিনের পীড়া বা অসুস্থজনিত ছুটি ভোগের অধিকারী। ১১৭ ধারায় এক বছর চাকরি পূর্ণ হলে প্রতিষ্ঠান ভেদে আঠার দিন কাজের জন্য একদিন, বাইশ দিন কাজের জন্য একদিন; এগার দিন কাজের জন্য একদিন হিসেবে মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি পাওয়ার আইনত অধিকারী। প্রত্যেক শ্রমিককে প্রত্যেক পঞ্জিকা বছর মজুরিসহ এগার দিনের উৎসব ছুটি মঞ্জুর করতে হবে। একজন মহিলা শ্রমিক এ আইনের ৪৬ ধারায় সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের অব্যবহিত পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহ প্রসূতিকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকারী। একজন শ্রমিক স্বেচ্ছায় তার চাকরির অবসান ঘটালে বর্তমান শ্রম আইনের ২৭ ধারার বিধান মোতাবেক যদি অবসান প্রত্যাশী শ্রমিকের চাকরি পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব কিন্তু দশ বছরের কম হয়। প্রতি বছর চাকরির জন্য ১৪ দিনের মজুরি এবং ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি পাওয়ার অধিকারী। এ আইনের ২৮ ধারায় কোনো শ্রমিক এক নাগাড়ে ২৫ বছর চাকরি করার পর অথবা শ্রমিকের বয়স ৫৭ বছর পূর্ণ হলে স্বাভাবিক নিয়মে অবসর গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে অবসর গ্রহণকারী শ্রমিক প্রতি বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি পাবেন। কোনো শ্রমিক তিন বছরের অধিককাল কোনো মালিকের অধীনে চাকরিরত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ওই শ্রমিকের মনোনীত ব্যক্তি বা তার পোষ্য পূর্ণ বছর বা ছয় মাসের অধিক সময়ের চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা অধিক তা পাবেন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ২৬ ধারায় মালিক কর্তৃক একজন শ্রমিকের চাকরি কোনো প্রকার কারণ না দেখিয়ে অবসান ঘটাতে পারেন। এ ক্ষেত্রে মালিক মাসিক মজুরির শ্রমিককে ১২০ দিনের লিখিত নোটিশ অথবা ১২০ দিনের মজুরি, মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিক ছাড়া অন্য শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ বা ৬০ দিনের মজুরি পরিশোধ করে শ্রমিকের চাকরির অবসান ঘটাতে পারেন।

ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত অধিকার :
এ আইনের ত্রয়োদশ অধ্যায় ট্রেড ইউনিয়ন এবং শিল্প সম্পর্কিত বিষয়ে ১৭৫ থেকে ২০৮ ধারা পর্যন্ত ব্যাপকভাবে আলোচনা করা হয়েছে। ট্রেড ইউনিয়ন করা শ্রম আইনে সুনির্দিষ্ট শ্রমিকের একটি অধিকার। শ্রমিক তার ইচ্ছানুযায়ী যে কোনো ট্রেড ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেন এবং আইনের বিধানসাপেক্ষে যে কোনো ট্রেড ইউনিয়ন গঠনও করতে পারেন। শ্রম আইন সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং আইন যথাযথভাবে পালন না করার কারণে বহু মালিক শ্রমিকের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি হয়। শ্রম আইন সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলে মালিক-শ্রমিক এ বিরোধ বহুলাংশে হ্রাস পাবে।

শ্রম আইনে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় কিছু অসংগতিঃ
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর আওতায় কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ কেমন হবে তার বিধান আলোচিত হয়েছে। ১৯২৩ সালের ওয়ার্কসম্যান কমপেনসেশন অ্যাক্ট এবং ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্টের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এ আইনটিতে বর্তমানে যুগোপযোগিতার যথেষ্ট অভাব ধরা পড়েছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিঘিœত হচ্ছে দারুণভাবে। আইনটির ১৫১ নং ধারা অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ রাখা হয়েছে।
এছাড়াও জখমজনিত কারণে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১,২৫,০০০ টাকা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য মাত্র ১০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের এ অর্থ বর্তমান সময়ে অত্যন্ত অপ্রতুল। আইনটিতে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটি বেশ গুরুত্ব পেলেও নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হলে মালিকপক্ষের দায়সম্পর্কিত কোনো বিধান রাখা হয়নি। ৬২নং ধারা অনুসারে শ্রমিকদের বহুতল কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক তলার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী একটি বিকল্প সিঁড়িসহ বহির্গমনের উপায় ও অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জামের ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। আইনানুসারে, কারখানার কোনো কক্ষের দরজা তালাবদ্ধ রাখা নিষিদ্ধ। এছাড়াও অগ্নিকান্ডের সময় হুশিয়ারি সঙ্কেতের ব্যবস্থা রাখা এবং অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম ও আগুন থেকে রক্ষা পেতে শ্রমিকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখার বাধ্যবাধকতার কথা বলা আছে এ আইনে। কিন্তু সমস্যা হলো, মালিকপক্ষ এ নির্দেশ অমান্য করলে তাদের কী শাস্তি পেতে হবে, তার কোনো বিধান নেই আইনটিতে। ঊনবিংশ অধ্যায়ে বিভিন্ন অপরাধের কারণে দন্ড ও শাস্তির বিধান রাখা হলেও কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য পরিবেশ নিশ্চিত না করতে পারার অপরাধে কী শাস্তি হতে পারে তার কোনো বিধান নেই এখানে। ফলে দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষ আইনে উল্লিখিত পরিমাণ কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ প্রদান করে পার পেয়ে যাচ্ছে কিন্তু শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ কারণে কলকারখানাগুলোয় দুর্ঘটনার আশঙ্কা মাথায় নিয়ে কাজ করে যেতে হচ্ছে শ্রমিকদের। আইনটির ৮০নং ধারা অনুসারে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে মালিকপক্ষের দায়িত্ব হলো পরবর্তী দুই কর্মদিবসের মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শককে সে সম্পর্কে নোটিশ মারফত অবহিত করা। কিন্তু এ বিধান লঙ্ঘন করলে যে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, তা একেবারেই অপর্যাপ্ত। ২৯০ নং ধারা অনুসারে দুর্ঘটনা সম্পর্কে নোটিশ দিতে ব্যর্থ হলে মালিকপক্ষকে সাংঘাতিক শারীরিক জখমের ক্ষেত্রে এক হাজার টাকা এবং জীবনহানির ক্ষেত্রে ছয় মাস কারাদন্ড অথবা তিন হাজার টাকা অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। অত্যন্ত অপ্রতুল এ শাস্তির কারণে মালিকপক্ষ দুর্ঘটনার পর সে সম্পর্কে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাবদিহি করছে না ।
 
শ্রম আইনে বিতর্কিত ৩০৭ ধারা :
২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনের ৩০৭ ধারায় বলা হয়েছে কোনও ব্যক্তি এ আইন বা কোন বিধি, প্রবিধান বা স্কিমের কোন বিধান লঙ্ঘন করলে বা মানতে ব্যর্থ হলে এবং ইহার জন্য শ্রম আইনে অন্য কোন দ-ের বিধান না থাকলে তিনি তিন মাস পর্যন্ত কারাদ- অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে অথবা উভয় দ-ে দ-নীয় হবেন। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০০৮ মূলে তৎকালীন সরকার ৩০৭ ধারায় ‘তিন মাস পর্যন্ত কারাদ-ে অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে অথবা উভয় দ-ে শব্দগুলো ও কথাগুলোর পরিবর্তে ‘পঁচিশ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। এদিকে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন মোতাবেক ৩০৭ ধারার সংশোধনীতে বলা হয় উল্লি¬খিত ‘তিন মাস পর্যন্ত কারাদ-ে অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে অথবা উভয় দ-ে’ শব্দগুলো ও কথাগুলোর পরিবর্তে ‘পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদ-ে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। অর্থাৎ শ্রম আইনের ওই সংশোধনীবলে শ্রম আইন ভঙ্গকারী মালিকদের কারাদ-ের বিধান তুলে দিয়ে কেবল অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ৩০৭ ধারায় শ্রমিকের অধিকার সংক্রান্ত আইন ভঙ্গ করলে মালিকের তিন মাসের কারাদ- বা অর্থদ- অথবা উভয় দ-ের বিধান ছিল। সংশোধনীতে এক্ষেত্রে শুধু পাঁচ হাজার টাকার অর্থেদ-ের বিধান রাখা হয়েছে।

শিশু শ্রম নিষিদ্ধ :
শ্রম আইনের ৩৪ ধারা মোতাবেক কোন পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোন শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেয়া যাবে না, যদি না বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কর্তৃক তাকে প্রদত্ত সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র মালিকের হেফাজতে থাকে। বাংলাদেশ শ্রম আইনের ২(৬৩) ধারানুসারে শিশু অর্থ চৌদ্দ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন কোন ব্যক্তি এবং কিশোর অর্থ চৌদ্দ বছর বয়স পূর্ণ করেছেন কিন্তু আঠার বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন কোন ব্যক্তি [ধারা ২ (৮)]। শিশু-কিশোর শ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও আমাদের দেশে কম বেশি প্রত্যেক শ্রেণীর শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিশু-কিশোর শ্রমিকদের উপস্থিতি লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আইন করে শিশু শ্রম বন্ধ করা যাবে না, এজন্য প্রয়োজন, মালিক পক্ষের সুদৃঢ় মনোবল এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শনের মানসিকতা। ভারতে ১০ অক্টোবর ২০০৬ থেকে ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। ভারতের ১৯৮৬ সালের শিশু শ্রমিক নিষিদ্ধ আইনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, কেউ বাড়ি, রাস্তার পাশের খাবার দোকান, হোটেল, মোটেল, চায়ের দোকান, প্রমোদ কেন্দ্র ও যে কোন বিনোদন কেন্দ্রে শিশুদের চাকরি দিলে তাকে এ আইনভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করা হবে। শাস্তি হিসেবে অপরাধীর দুই বছর পর্যন্ত কারাদ- অথবা ১০ থেকে ২০ হাজার রুপি পর্যন্ত জরিমানা করা হবে।

শ্রমিকদের জন্য আইনি সুরক্ষা :
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫ এবং ২০(১)-এ শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারে শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বিশেষ অনুচ্ছেদ হচ্ছে ৩৪ ও ৩৮। ৩৪ অনুচ্ছেদটি শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষাকবচ। এ অনুচ্ছেদ মোতাবেক সব ধরনের জবরদস্তি শ্রমনিষিদ্ধ। ৩৮ অনুচ্ছেদে জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার দেওয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক আইন:
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম ১৯১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য আন্তর্জাতিক কিছু নীতিমালা গৃহীত হয়। আইএলও কর্তৃক গৃহীত কনভেনশনগুলোর বেশ কিছু বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন করেছে। কিন্তু ওই কনভেনশন অনুযায়ী চলে না বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা।

Adv Siraz


সিরাজ প্রামাণিক
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইন গ্রন্থ প্রণেতা।

Post a Comment

0 Comments