কল-কারখানার চাকা ঘুরলেই উৎপাদন হয়।
উৎপাদন প্রক্রিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণি।
যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিক শ্রেণির অবদান অপরিসীম। কিন্তু
সৃষ্টির আদিকাল থেকে এ শ্রমিক শ্রেণি অবহেলিত, বঞ্চিত। ন্যায্য পাওনা আর
কর্মঘণ্টা নির্ধারণের দাবি আদায়ের জন্য অগণিত শ্রমিক রাজপথে জীবন উৎসর্গ
করেছেন। পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিক আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মরণীয় ঘটনা লেখা
আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৩২ বছর আগে
১৮৮৬ সালের ১মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকদের মানবিক শ্রমঘণ্টা নির্ধারণ
হয়েছিল। ১৮৮৯ সাল থেকে ১মে শ্রমিক সংহতির ও শ্রেণি-সংগ্রামের প্রতীকী দিবস
হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো
বাংলাদেশেও ১মে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু তারপরও দেশের লাখ লাখ
শ্রমিক প্রতিনিয়ত তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। শ্রমিকদের
ন্যায্য মজুরি, সুনির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, মালিকের সঙ্গে শ্রমিকের সম্পর্ক,
শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার ও দায়-দায়িত্ব নিয়ে প্রণীত হয়েছে ‘বাংলাদেশ শ্রম
আইন ২০০৬’।
প্রায়ই খবরের কাগজে ফ্যাক্টরিতে কিংবা
দোকানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক নিহত ও আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায়। অনেক
সময় মালিকপক্ষের গাফিলতির কারণে এ রকম বড় বড় দুর্ঘটনা ঘটে থাকে বলে জানা
যায়। মালিকপক্ষও অগ্নিকাণ্ডের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া আহত শ্রমিকদের
চিকিৎসাসেবা প্রদান এবং নিহতদের সাধ্যমত ক্ষতিপূরণের আশ্বাস দেন। অপরদিকে
বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন আহত ও নিহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণের জন্য বিভিন্ন
দাবি-দাওয়া সরকারের কাছে তুলে ধরেন। গার্মেন্ট বা ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে
শ্রমিক মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। অল্প বেতনে
চাকরি করা এসব শ্রমিকের স্বার্থ যথাযথভাবে রক্ষা করা হয় না। মালিকপক্ষের
সামান্য অবহেলা বা গাফিলতির কারণে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যায়। আমাদের
সমাজে শ্রমিকদের অবদান থাকলেও তারা তাদের ন্যূনতম আইনগত অধিকারসহ
মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যথাযথ মজুরি না দেওয়া, বাসস্থান, পরিবহন ও
অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা না থাকা, সাপ্তাহিক ছুটি না দেওয়া, বাধ্যতামূলক
অতিরিক্ত সময় কাজ করানো, মাতৃত্বকালীন ছুটি না দেওয়া একটি নিয়মিত সমস্যা।
আইনে থাকলেও পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য কোনো শিশু পরিচর্যা কেন্দ্রের
ব্যবস্থা না থাকা, আগুন লাগাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য বিকল্প
ব্যবস্থার পর্যাপ্ত অভাব, শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা না থাকাও
আমাদের শ্রমিকদের বড় সমস্যা।
আইনে একজন শ্রমিকের অধিকার
শ্রমিকের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে ‘শ্রমিক অর্থ
শিক্ষাধীনসহ কোনো ব্যক্তি, তার চাকরির শর্তাবলি প্রকাশ্য বা উহ্য যেভাবেই
থাকুক না কেন, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরি বা ঠিকাদারের
মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোনো দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরি,
ব্যবসায় উন্নয়নমূলক অথবা কেরানিগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন। কিন্তু
প্রধানত, প্রশাসনিক বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি
এর অন্তর্ভুক্ত হবে না। শ্রম আইন-২০০৬-এর অধীনে একজন শ্রমিক কোনো মালিকের
কারখানায় শ্রমিক হিসেবে চাকরিতে নিযুক্ত হলে এ আইনের ৫ ধারায় নিয়োগপত্র ও
পরিচয়পত্র পাওয়ার অধিকারী। চাকরিকালীন সময় একজন শ্রমিক ১০৩ ধারা অনুসারে
প্রতিষ্ঠান ভেদে এক দিন, দেড় দিন, ২৪ ঘণ্টা সাপ্তাহিক ছুটি ভোগ করতে
পারবেন। ওই রূপ ছুটির জন্য তার মজুরি থেকে কোনোরূপ কর্তন করা যাবে না। শ্রম
আইনের ১১৫ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক প্রতি পঞ্জিকা বছরে পূর্ণ মজুরিতে দশ
দিনের নৈমিত্তিক ছুটি পাওয়ার অধিকারী হবেন। ১১৬ ধারায় প্রত্যেক শ্রমিক
প্রতি এক বছরে পূর্ণ মজুরিতে ১৪ দিনের পীড়া বা অসুস্থজনিত ছুটি ভোগের
অধিকারী। ১১৭ ধারায় এক বছর চাকরি পূর্ণ হলে প্রতিষ্ঠান-ভেদে আঠার দিন কাজের
জন্য একদিন, বাইশ দিন কাজের জন্য একদিন; এগার দিন কাজের জন্য একদিন হিসেবে
মজুরিসহ বার্ষিক অর্জিত ছুটি পাওয়ার আইনত অধিকারী। প্রত্যেক শ্রমিককে
প্রত্যেক পঞ্জিকা বছর মজুরিসহ এগার দিনের উৎসব ছুটি মঞ্জুর করতে হবে। একজন
মহিলা শ্রমিক এ আইনের ৪৬ ধারায় সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের অব্যবহিত
পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান প্রসবের অব্যবহিত পরবর্তী আট সপ্তাহ
প্রসূতিকালীন ছুটি পাওয়ার অধিকারী। একজন শ্রমিক স্বেচ্ছায় তার চাকরির অবসান
ঘটালে বর্তমান শ্রম আইনের ২৭ ধারার বিধান মোতাবেক যদি অবসান প্রত্যাশী
শ্রমিকের চাকরি পাঁচ বছর বা তদূর্ধ্ব কিন্তু দশ বছরের কম হয়। প্রতিবছর
চাকরির জন্য ১৪ দিনের মজুরি এবং ১০ বছর বা তদূর্ধ্ব মেয়াদের চাকরির জন্য ৩০
দিনের মজুরি পাওয়ার অধিকারী। এ আইনের ২৮ ধারায় কোনো শ্রমিক এক নাগাড়ে ২৫
বছর চাকরি করার পর অথবা শ্রমিকের বয়স ৫৭ বছর পূর্ণ হলে স্বাভাবিক নিয়মে
অবসর গ্রহণ করবেন। এক্ষেত্রে অবসর গ্রহণকারী শ্রমিক প্রতিবছর চাকরির জন্য
৩০ দিনের মজুরি পাবেন। কোনো শ্রমিক তিন বছরের অধিককাল কোনো মালিকের অধীনে
চাকরিরত থাকা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে ওই শ্রমিকের মনোনীত ব্যক্তি বা তার
পোষ্য পূর্ণ বছর বা ছয় মাসের অধিক সময়ের চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা
গ্র্যাচুইটি, যা অধিক তা পাবেন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর ২৬ ধারায় মালিক
কর্তৃক একজন শ্রমিকের চাকরি কোনো প্রকার কারণ না দেখিয়ে অবসান ঘটাতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে মালিক মাসিক মজুরির শ্রমিককে ১২০ দিনের লিখিত নোটিশ অথবা ১২০
দিনের মজুরি পরিশোধ করে বিদায় করবেন। আবার মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত
শ্রমিক ছাড়া অনিয়মিত শ্রমিকের ক্ষেত্রে ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ বা ৬০ দিনের
মজুরি পরিশোধ করে শ্রমিকের চাকরির অবসান ঘটাতে পারেন।
শ্রম আইনে শ্রমিকের স্বার্থ রক্ষায় কিছু অসঙ্গতি
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর আওতায়
কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং দুর্ঘটনাকবলিত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ
কেমন হবে তার বিধান আলোচিত হয়েছে। ১৯২৩ সালের ওয়ার্কসম্যান কমপেনসেশন
অ্যাক্ট এবং ১৯৬৫ সালের ফ্যাক্টরিজ অ্যাক্টের ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এ
আইনটিতে বর্তমানে যুগোপযোগিতার যথেষ্ট অভাব ধরা পড়েছে। ফলে কর্মক্ষেত্রে
শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে দারুণভাবে। আইনটির ১৫১ নং ধারা অনুযায়ী
কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনায় নিহতদের জন্য ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ রাখা হয়েছে। এ
ছাড়া জখমজনিত কারণে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ অক্ষম হয়ে যাওয়া শ্রমিকদের
ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ১,২৫,০০০ টাকা এবং অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য
মাত্র ১০,০০০ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের এ অর্থ
বর্তমান সময়ে অত্যন্ত অপ্রতুল। আবার ৬২ নম্বর ধারা অনুসারে বিকল্প সিঁড়ি,
অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য পরিবেশ নিশ্চিত
করার কথা বলা হয়েছে। এ আইনটিতে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে তাদের নিরাপত্তার
ব্যাপারটি বেশ গুরুত্ব পেলেও নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হলে মালিকপক্ষের দায়
সম্পর্কিত কোনো বিধান রাখা হয়নি। ফলে দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষ আইনে উল্লিখিত
পরিমাণ কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে তার চেয়ে বেশি ক্ষতিপূরণ প্রদান করে পার পেয়ে
যাচ্ছে কিন্তু শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে
কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
উপরন্তু ২০০৬ সালের বাংলাদেশ শ্রম আইনের
৩০৭ ধারায় বলা হয়েছে কোনো ব্যক্তি এ আইন বা কোনো বিধি, প্রবিধান বা স্কিমের
কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে বা মানতে ব্যর্থ হলে এবং ইহার জন্য শ্রম আইনে অন্য
কোনো দণ্ডের বিধান না থাকলে তিনি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ড অথবা এক হাজার
টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবেন। কিন্তু সর্বশেষ ২০০৯
সালে বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) আইন মোতাবেক ৩০৭ ধারার সংশোধনীতে বলা হয়
উল্লিখিত ‘তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে অথবা এক হাজার টাকা পর্যন্ত
অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে’ শব্দগুলো ও কথাগুলোর পরিবর্তে ‘পাঁচ হাজার টাকা
পর্যন্ত অর্থদণ্ডে’ শব্দগুলো প্রতিস্থাপিত হবে। অর্থাৎ শ্রম আইনের ওই
সংশোধনীবলে শ্রম আইন ভঙ্গকারী মালিকদের কারাদণ্ডের বিধান তুলে দিয়ে কেবল
অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
শিশুশ্রম নিষিদ্ধ
শ্রম আইনের ৩৪ ধারা মোতাবেক কোনো পেশায় বা
প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশু বা কিশোরকে নিয়োগ করা যাবে না বা কাজ করতে দেওয়া
যাবে না, যদি না বিধি দ্বারা নির্ধারিত ফরমে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক
কর্তৃক তাকে প্রদত্ত সক্ষমতা প্রত্যয়নপত্র মালিকের হেফাজতে থাকে। বাংলাদেশ
শ্রম আইনের ২(৬৩) ধারানুসারে শিশু অর্থ চৌদ্দ বছর বয়স পূর্ণ করেনি এমন কোনো
ব্যক্তি এবং কিশোর অর্থ চৌদ্দ বছর বয়স পূর্ণ করেছেন কিন্তু আঠার বছর বয়স
পূর্ণ করেনি এমন কোনো ব্যক্তি। শিশু-কিশোর শ্রম নিষিদ্ধ করা হলেও আমাদের
দেশে কম বেশি প্রত্যেক শ্রেণির শিল্প প্রতিষ্ঠানে শিশু-কিশোর শ্রমিকদের
উপস্থিতি লক্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আইন করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যাবে না,
এজন্য প্রয়োজন, মালিক পক্ষের সুদৃঢ় মনোবল এবং আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
প্রদর্শনের মানসিকতা।
শ্রমিকদের জন্য আইনি সুরক্ষা
বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্র পরিচালনার
মূলনীতিতে অনুচ্ছেদ ১৪, ১৫ এবং ২০(১)-এ শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বলা হয়েছে। এ
ছাড়া সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারে শ্রমিকদের অধিকার বিষয়ে বিশেষ
অনুচ্ছেদ হচ্ছে ৩৪ ও ৩৮। এসব অনুচ্ছেদ মোতাবেক সব ধরনের জবরদস্তি শ্রম
নিষিদ্ধ এবং জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত
যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার দেওয়া
হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)
প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর প্রথম ১৯১৯ সালে কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের জন্য
আন্তর্জাতিক কিছু নীতিমালা গৃহীত হয়। আইএলও কর্তৃক গৃহীত কনভেনশনগুলোর বেশ
কিছু বাংলাদেশ সরকার অনুমোদন করেছে। কিন্তু ওই কনভেনশন যথাযথভাবে
বাংলাদেশের শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষায় প্রতিপালিত হয় না।
সিরাজ প্রামাণিক
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
seraj.pramanik¦gmail.com
0 Comments