কীভাবে সিভি তৈরি করব? |
জীবনের শুরু থেকেই নানা প্রয়োজনে জীবনবৃত্তান্ত বা
সিভি তৈরি করতে হয়। আর বৃত্তি বা কোনো সভা-সম্মেলন-ফেলোশিপে অংশগ্রহণের জন্যও এখন
সিভি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিজের পরিচয়, অর্জন, যোগ্যতার কথা সংক্ষেপে কীভাবে
তুলে ধরব? সিভিতে কী থাকবে আর কী থাকবে না? পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সহকারী অধ্যাপক ও ব্যবসায় যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ
সাইফ নোমান খান। নমুনা হিসেবে এখানে বাংলায় লেখা সিভি তুলে ধরা হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে
যেহেতু ইংরেজি ভাষায় সিভি লিখতে হয়, তাই একই নিয়ম ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য
হবে।
সিভিতে যা যা থাকবে
নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা
সিভির প্রথম অংশে পুরো নাম লিখতে হবে। কোনোভাবেই
ডাকনাম বা ছদ্মনাম লেখা যাবে না। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের
সনদপত্রে যে নাম লেখা আছে তা-ই লিখতে হবে। নামের আগে মিস্টার বা মিসেস ব্যবহার করা
যাবে না।
ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রে চিঠিতে যোগাযোগ করা যায়, এমন
ঠিকানা স্পষ্ট কিন্তু সংক্ষিপ্ত আকারে লিখতে হবে। যোগাযোগের জন্য দিতে হবে মুঠোফোন
নম্বর। অপ্রয়োজনে ২-৩টি ফোন নম্বর লেখা যাবে না। আর বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে ই-মেইল
ঠিকানার ক্ষেত্রে। iamgreat@gmail. com বা sweetdreams@ymail. com—এ ধরনের হাস্যকর
ই-মেইল ঠিকানা ব্যবহার করা যাবে না। নিজের নামের সঙ্গে মেলে এমন সংক্ষিপ্ত ই-মেইল
ঠিকানা তৈরি করে সিভিতে ব্যবহার করতে হবে।
লিংকড–ইন প্রোফাইলের আইডি ব্যবহার করতে পারেন।
প্রয়োজন না হলে ফেসবুক আইডি যুক্ত না করাই শ্রেয়। তবে ব্যক্তিগত ওয়েবসাইট কিংবা
নিজ কাজের পোর্টফোলিও প্রকাশিত হয়েছে এমন ওয়েবসাইটের নাম লেখা যেতে পারে।
ছবি
সিভিতে যে ছবি যুক্ত করবেন তা যেন সাম্প্রতিক সময়ে
তোলা হয়। ছবির পটভূমি এক রঙের হতে হবে। চুল কিংবা দাড়ি পরিপাটি থাকতে হবে ছবিতে।
চেহারা বোঝা যায় এমন যেকোনো ছবি ব্যবহার করতে পারেন।
পেশাগত লক্ষ্য
সিভিতে অবশ্যই আপনার পেশাগত লক্ষ্য লিখতে হবে। ভাষা
হবে সংক্ষিপ্ত ও প্রাঞ্জল, গোছানো ভাষায়। যদি ইংরেজিতে লেখেন, বানান বা ব্যাকরণ
যেন ভুল না হয়। যে পদে আবেদন করবেন তার সঙ্গে সম্পৃক্ত লক্ষ্য লিখতে হবে। আজগুবি,
অপ্রাসঙ্গিক কিংবা কাল্পনিক কোনো বাক্য লেখা যাবে না।
শিক্ষা
সদ্য যে ডিগ্রি অর্জন করেছেন, সেটা লিখতে হবে
প্রথমে। কোন বিষয়ে, কোন অনুষদে পড়েছেন, কত সালে পরীক্ষা দিয়েছেন, গ্রেড পয়েন্ট বা
ফলাফল কী ছিল, এসবও উল্লেখ করতে পারেন। এখনো পাস করে না থাকলে ‘পরীক্ষার্থী’
শব্দটি লিখুন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় থেকে ক্রমানুসারে মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত
ফলাফলের তথ্য লিখতে হবে।
একাডেমিক প্রকাশনা বা প্রকল্প
স্নাতকপর্যায়ে পড়াকালীন কোনো গবেষণা বা রিপোর্ট
প্রকাশিত হলে তা লিখুন। প্রকৌশল পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নিজের কোনো প্রকল্পের নাম
যুক্ত করতে পারেন। যাঁরা ব্যবসায়ে প্রশাসনে পড়ছেন, তাঁরা ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করলে
তার রিপোর্টের নাম লিখুন। কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক সম্মেলনে অংশ নিলে তার
সংক্ষিপ্ত তথ্য যুক্ত করুন।
পেশাগত অভিজ্ঞতা
সাধারণত স্নাতকপড়ুয়া বা সদ্য উত্তীর্ণ
শিক্ষার্থীদের সরাসরি পেশাগত অভিজ্ঞতা থাকে না। কিন্তু যে পদের চাকরির জন্য সিভি
তৈরি করছেন, সেই সংশ্লিষ্ট কাজের অভিজ্ঞতা থাকলে তা যুক্ত করুন। যেমন কোনো মেলায়
বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করলে তা লিখুন বা কোনো কল সেন্টারে কাজ করে থাকলে তা-ও
লিখতে পারেন। কোন পদে কাজ করেছেন, কত দিন করেছেন তা উল্লেখ করুন। কোনো সম্মেলন বা
অনুষ্ঠানে আয়োজক হিসেবে কাজ করে থাকলে তা-ও লিখুন।
স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজ
আপনি স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যে কাজ বা সংগঠনে যুক্ত
তার তথ্য লিখতে হবে। কত দিন ধরে কাজ করছেন, কোন পদে কাজ করছেন তা লিখুন। প্রয়োজন
হলে, প্রতিটি কাজের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত করে কাজের বর্ণনা দিন।
কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ
বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে যেসব কর্মশালায় অংশ নিয়েছেন বা
প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন তার তালিকা যুক্ত করতে হবে। চাকরির পদের সঙ্গে গুরুত্ব
বুঝে কর্মশালা ও প্রশিক্ষণের তথ্য যোগ করুন। কর্মশালার নাম ও আয়োজকদের তথ্য
সংক্ষিপ্ত করে লিখুন। ধরুন, আপনি বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরির জন্য সিভি তৈরি
করছেন, তাহলে বিক্রয় ও বিপণন-সম্পর্কিত তথ্য যোগ করুন। অনলাইনের মাধ্যমে কোনো
ডিগ্রি বা প্রশিক্ষণ নিলে তা-ও সিভিতে যুক্ত করুন।
ভাষা দক্ষতা
সাধারণভাবে বাংলাদেশে চাকরির আবেদনের জন্য বাংলা ও
ইংরেজি জানা আবশ্যিক। ইংরেজি ভাষা দক্ষতা-সংশ্লিষ্ট কোনো পরীক্ষা—যেমন আইইএলটিএস
বা টোয়েফলে অংশ নিলে তার স্কোর লিখুন। অন্য কোনো ভাষা জানলে সেটিও উল্লেখ করুন।
কম্পিউটার-দক্ষতা
যে পদের জন্য সিভি তৈরি করছেন, সেই পদের কথা মাথায়
রেখে কম্পিউটার–দক্ষতা লিখতে হবে। এখন সব পর্যায়ের চাকরির জন্য মাইক্রোসফট ওয়ার্ড,
এক্সেল ও পাওয়ারপয়েন্ট জানাকে সাধারণ দক্ষতা হিসেবে ভাবা হয়। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল
ও পাওয়ারপয়েন্টের কাজ খুব ভালো জানলে তা অবশ্যই সিভিতে যুক্ত করবেন। ডেটা
অ্যানালাইসিস, ম্যাক্রো কিংবা মাইক্রোসফটের কোনো প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকলে তা লিখতে
পারেন। এ ছাড়া টেকনিক্যাল সফটওয়্যার যেমন ম্যাটল্যাব বা এসপিএসএস শেখা থাকলে সেটিও
উল্লেখ করুন।
শখ ও আগ্রহ
নিজের দু-একটি আগ্রহ ও শখের কথা লিখতে পারেন।
রেফারেন্স
সদ্য স্নাতকদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই
ভালো রেফারেন্স হিসেবে কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে শিক্ষককে জানিয়ে তাঁর নাম ও পদবি
ব্যবহার করুন। কখনো কখনো চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠান থেকে রেফারেন্সে যাঁর নাম থাকে,
তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাই সঠিক পদ ও পরিচয় ব্যবহার করুন। অন্য কোনো পেশার
পরিচিত কোনো পেশাজীবীর নাম ও পদবি যুক্ত করতে পারেন।
অঙ্গীকারনামা
সিভিতে যুক্ত আপনার সব তথ্য সঠিক ও নির্ভুল তা
লিখতে হবে। লেখার নিচে আপনার স্পষ্ট স্বাক্ষর থাকতে হবে। চাকরিদাতা আপনার তথ্য
যাচাই করার আইনগত অধিকার রাখেন, তাই কোনো ভুল তথ্য দেবেন না।
মনে রাখা জরুরি
■ অনেকেই অন্যের জীবনবৃত্তান্ত প্রায় হুবহু অনুকরণ করে
নিজের সিভি তৈরি করেন। এটা একেবারেই ঠিক নয়। চাকরিদাতারা কিন্তু সিভিতে চোখ
বুলিয়েই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। অন্য কাউকে দিয়ে সিভি তৈরি করালেও সেটা ধরা পড়ে
যায়। যে নিজের সিভি নিজে তৈরি করতে পারে না, একজন চাকরিদাতা কোন ভরসায় তাঁকে
দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ দেবেন? তাই জীবনের প্রথম সিভি নিজেকেই তৈরি করতে হবে।
ইন্টারনেট ঘেঁটে দারুণ কিছু সিভির নমুনা পাওয়া যাবে। সেগুলো দেখে একটা ধারণা নিতে
পারেন। তারপর নিজের সিভি নিজেই লিখুন। এখানে আমরা একটা নমুনা সিভি তুলে ধরেছি
স্রেফ ধারণা দেওয়ার জন্য। কোনোভাবেই এটা হুবহু অনুকরণ করা ঠিক হবে না।
■ সিভিকে আকর্ষণীয় করে তুলতে অনুচ্ছেদ বা প্যারাগ্রাফের
বদলে বুলেট পয়েন্ট ব্যবহার করতে পারেন। কখনোই ‘প্রথম পুরুষে’ সিভি লিখবেন না। যেমন
‘২০১৬ সালে আমি জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছি’ না লিখে বুলেট দিয়ে লিখতে
হবে, ‘জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় প্রথম, ২০১৬’। সংবাদপত্রের শিরোনাম যেমন স্পষ্ট ও
সংক্ষিপ্ত হয়, তেমন করে তথ্য যুক্ত করতে হবে।
■ প্রথম সিভি তৈরির পর তা অভিজ্ঞ দু-একজনকে দেখিয়ে নেওয়া
যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক বা বিভাগের কোনো সিনিয়রের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
■ সিভিতে কোনোভাবেই বানান ভুল করা যাবে না। বারবার মনোযোগ
দিয়ে পড়ে, সম্পাদনা করতে হবে। সিভি যেন কোনোভাবেই দুই পৃষ্ঠার বেশি না হয়। এক
পৃষ্ঠায় শেষ করতে পারলে ভালো।
■ একই সিভি অনেক জায়গায় জমা দেওয়া বা ই-মেইল করা ঠিক হবে
না। চাকরি ও পদভেদে সিভির ভাষা পরিবর্তন করতে হবে। পেশাগত লক্ষ্য কিন্তু একেক পদের
জন্য একেক রকম হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
■ এ-ফোর আকারের কাগজের মাপে সিভি তৈরি করতে হবে। চারপাশে ১
ইঞ্চি পরিমাণ ‘মার্জিন’ রাখতে হবে। সাদা কাগজে কালো কালিতে তথ্যগুলো লেখা থাকবে।
সিভির পটভূমিতে অন্য কোনো রং ব্যবহার না করাই ভালো।
■ শুধু সিভি কোথাও জমা দেবেন না বা ইমেইল করবেন না। সিভির
সঙ্গে ‘কভার লেটার’ যুক্ত করতে হবে। আপনি কেন চাকরির জন্য আবেদন করছেন, আপনি কেন
যোগ্য, তা সংক্ষিপ্ত আকারে কভার লেটারে লিখতে হবে।
(Collected from Prothom Alo Newspaper)
0 Comments